সেদিন অনলাইনে দেখছিলাম বিউটি আর মেকআপ প্রোডাক্টের ওপরে দারুণ সেল চলছে। অনেকক্ষণ ব্রাউজ করার পর কিছুই কিনলাম না। অবশ্য কিনলাম না বললে ভুল হবে, কিনতে পারলাম না; কারন আমার স্কিন প্রচণ্ড সেনসিটিভ আর বাজারচলতি খুব কম প্রোডাক্ট আছে যা আমি ব্যবহার করতে পারি! এরকম সমস্যা যে শুধু আমার একার তা কিন্তু নয়, এরকম অনেকেই আছেন যাদের সেনসিটিভ স্কিন আর কোনরকম প্রোডাক্ট কেনার বা ব্যবহার করার আগে তাদের দশবার ভাবতে হয়। এমনিতেই দূষণ, ধোঁয়া, ধুলো, সূর্যের ক্ষতিকর ইউভি রশ্মি আর মেকআপের ফলে ত্বকের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়, তার ওপরে ত্বক যদি সংবেদনশীল হয় তাহলে তো হয়েই গেল! সেনসিটিভ স্কিনের যত্ন ভীষণ সাবধানে নিতে হয় কারন একটুতেই স্কিনে র্যাশ বেরিয়ে যায় আর তার থেকে আরম্ভ হয় ব্রন, ফুসকুড়ি, ইচিং-এর মতো সমস্যা। আজকে আমরা এই বিষয়েই বিশদে আলোচনা করবো –
কীভাবে সেনসিটিভ স্কিনের যত্ন নেওয়া উচিত
সংবেদনশীল (Sensitive) ত্বকের যত্ন নেবার আগে যে বিষয়টা না জানলেই নয় সেটা হল, সংবেদনশীল ত্বক ব্যাপারটা কি। যখন স্কিন একেবারে রুক্ষ হয়ে যায় কিম্বা স্কিনে দানা, ব্রণ, লালচে ছোপ, র্যাশ, অ্যালার্জি অথবা অন্য স্কিনের সমস্যা দেখা দেয় তখন সেটা সেনসিটিভ স্কিনের লক্ষণ। এমতাবস্থায় ত্বকে টান ধরে এবং শুষ্ক হয়ে যায়। এই ধরনের ত্বকের যত্ন নেওয়াটা সারা বছরই কিন্তু ভীষণ জরুরি, আর শীতকালে তো বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া উচিত। ফেস প্যাক কিম্বা বডি স্ক্রাব তো ছেড়েই দিন, কোন ক্রিম লাগানোর আগেও বারবার ভাবতে হয়। সেনসিটিভ স্কিনের সমস্যা যে শুধু ত্বকের ওপরেই প্রভাব ফেলে তা নয়, ভ্রু থ্রেডিং করার সময়ও র্যাশ বেরিয়ে যায়, লালচে ছোপ পড়ে আর চুলকোয়ও।
আমার তো সবসময়েই মনে হয় যে আমার স্কিন টাইপ কেন সেনসিটিভ! আসলে কি বলুন তো, প্রথম থেকেই আমার স্কিন এরকম ছিলোনা, বড় হবার সাথে সাথে আমার ত্বক সংবেদনশীল হয়ে গেছে আর সেটার কারন যে কি কে জানে! পরে অবশ্য একজন স্কিন স্পেস্যালিস্ট-এর থেকে জানতে পারেছিলাম কারণটা। আমারদের ত্বকের অনেকগুলো স্তর থাকে, সবচেয়ে বাইরে যে স্তরটি থাকে তাকে ‘এপিডারমিস’ বলা হয় যা স্কিনকে প্রটেক্ট করে রাখে। যখন এই এপিডারমিস ড্যামেজ হয় তখন স্কিন সেনসিটিভ হতে আরম্ভ করে, কারন ধুলো, ময়লা, ক্ষতিকর ইউভি রশ্মি, দূষণ ইত্যাদি থেকে ত্বককে রক্ষা করা সম্ভব হয়না। এছাড়া খেয়াল করে দেখবেন আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়ে, বেশিক্ষন রোদে থাকলে কিম্বা বেশি মেকআপ ব্যাবহার করলেও ত্বকের সেন্সিটিভিটি বেড়ে যায় আর তখন স্কিনে র্যাশ, ফুসকুড়ি আর ইচিং-এর মতো সমস্যা শুরু হয়ে যায়।
ধুলো, ময়লা, দূষণ এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক জিনিসের থেকে ত্বককে রক্ষা করার জন্য দিনে দু’বার (সকালে এবং রাত্রে) ভালো করে মুখ ধুয়ে পরিস্কার করা জরুরি। আপনি যদি মনে করেন যে যত বেশি মুখ ধোবেন ততো বেশি স্কিনের ভালো হবে তাহলে জেনে রাখুন যে এই ভাবনা একেবারেই ভুল। কারন দু’বারের বেশি মুখ ধুলে স্কিনে ইরিটেশন হতে পারে। মুখ ধোবার পর তোয়ালে দিয়ে রগড়ে রগড়ে না মুছে জাস্ট ড্যাব করে নিন, অর্থাৎ একটা নরম তোয়ালে বা টিস্যু দিয়ে আসতে আসতে চেপে চেপে মুখের জলটা মুছে নিন। অনেকেই আছেন যারা বাইরে থেকে এসে মুখ না ধুয়েই শুয়ে পড়েন। সারাদিনের ধুলো, মেকআপ এগুলো যে ভালোভাবে পরিস্কার করা উচিত সেটা ভুলে যান। মেকআপ ঠিকভাবে না তুললে কিন্তু স্কিনের প্রচণ্ড ক্ষতি হয় আর স্কিন যদি সংবেদনশীল হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। সেনসিটিভ স্কিনে মেকআপ তোলার জন্য অলিভ অয়েল কিম্বা খুব মাইল্ড কোন মেকআপ রিমুভার ব্যবহার করুন।
এছাড়া মনে রাখবেন, কেমিক্যালযুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার করবেন না। এখন নানারকম হারবাল বিউটি প্রোডাক্ট আর মেকআপ পাওয়া যায়, দরকার হলে সেগুলো ব্যবহার করুন। আর একান্তই যদি কেমিক্যালযুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে হয় তাহলে যতটা কম সম্ভব ব্যবহার করুন। কারন বেশি কেমিক্যাল মানেই কিন্তু সেনসিটিভ স্কিনের বেশি ক্ষতি। আরেকটা ব্যাপার মাথায় রাখবেন, যতটা সম্ভব ক্লোরিনযুক্ত জলের থেকে দূরে থাকুন, সুইমিং পুল কিম্বা ওয়াটার পার্কের জলে কিন্তু ক্লোরিন মেশানো থাকে যা আপনার ত্বকের পক্ষে খুব খারাপ।
সংবেদনশীল ত্বকের যত্ন নেবার জন্য আপনি ঘরোয়া টোটকা ট্রাই করে দেখতে পারেন। আপনার বাড়িতেই, বিশেষকরে রান্নাঘরে এমন অনেক উপকরণ আছে যে দিয়ে আপনি আরামসে ত্বকের যত্ন নিতে পারেন এবং সেটাও কোনরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই –
১। দই আর মধু তো সবার বাড়িতেই থাকে। দই আর মধুর সাথে কয়েক ফোঁটা ল্যাভেন্ডার অয়েল (এসেনশিয়াল অয়েল নেবেন, অ্যারোমা অয়েল না) মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে মুখে লাগিয়ে নিন। দশ মিনিট পরে ভালো করে ঠাণ্ডা জলে ধুয়ে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে নিন। এতে আপনার স্কিনের শুষ্কভাব দূর হবে।
২। সেনসিটিভ স্কিনের জন্য অ্যালোভেরা খুব ভালো কাজ দেয়। অ্যালোভেরাতে ভিটামিন ই রয়েছে যা নানাধরনের স্কিন প্রবলেম যেমন র্যাশ, ইচিং ইত্যাদির উপশমে অতুলনীয়। অ্যালোভেরার পাতা কেটে নিয়ে তার ভেতর থেকে জেল বার করে নিন। যেখানে যেখানে র্যাশ আছে সেখানে এবং গলায় অ ঘাড়ে জেল লাগিয়ে নিন। সারা রাত এভাবে রেখে পরদিন সকালে ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে নিন। অ্যালোভেরা জেল লাগানোর পরে একটু ইচিং হতে পারে কিন্তু তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
৩। প্রাকৃতিকভাবে উজ্জ্বল ত্বক পাবার জন্য অনেকেই মধু ব্যবহার করেন। একটা কাঁচের বা চিনামাটির বাটিতে দুই টেবিল চামচ মধু আর দুই চা চামচ দারচিনি পাউডার ভালো করে মিশিয়ে মুখে আর গলায় লাগিয়ে নিয়ে ১৫ মিনিট রেখে দিন। পরে শুধু জল দিয়ে ধুয়ে নিন। এই মিশ্রণ সেনসিটিভ ত্বককে নরম এবং কমনীয় রাখতে সাহায্য করে।
৪। আপনার কাছে যদি অ্যাভোকাডো থাকে তাহলে একটা অ্যাভোকাডোর ভেতরের অংশ নিয়ে তার সাথে মধু মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। এবারে যেখানে যেখানে ইচিং বা র্যাশ আছে সেখানে ওই পেস্ট লাগিয়ে নিন। ১০ মিনিট পর জল দিয়ে ধুয়ে নিন। এতে সেনসিটিভ স্কিনের ইচিং এবং জ্বালা দূর হয় আর আরাম মেলে।
৫। কলা খাওয়া যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, সেটা তো আমরা সবাই জানি, কিন্তু সেনসিটিভ স্কিনের জন্যও যে কলা খুব উপকারী সেটা কি আপনি জানেন? একটা পাকা কলার পেস্ট বানিয়ে তার মধ্যে এক চামচ মধু আর ২ চামচ টক দই মিশিয়ে ভালো করে মুখে লাগিয়ে নিন। ৭ থেকে ১০ মিনিট এই প্যাক রেখে ধুয়ে ফেলুন।
৬। হলুদ অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে খুবই ব্যবহৃত হয়। আপনার যদি সেনসিটিভ স্কিন হয় তাহলে আপনি হলুদ দিয়ে তৈরি এই ফেস প্যাকটি লাগাতে পারেন। খুব সহজেই আপনি এই প্যাকটি বানাতে পারবেন। এক টেবিল চামচ হলুদ নিয়ে (আপনি চাইলে কাঁচা হলুদ বেটে নিতে পারেন) তাতে কয়েক ফোঁটা অলিভ অয়েল এবং দুই টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে এই প্যাক মুখে লাগিয়ে নিন, সাথে গলায় এবং ঘাড়েও লাগান। শুকিয়ে গেলে ঠাণ্ডা জল দিয়ে ধুয়ে নিন। হলুদ যেহেতু অ্যান্টিসেপ্টিক তাই ব্রণ ফুসকুড়ি এবং ত্বকের অন্যান্য ইনফেকশন দূর করতে সাহায্য করে, আবার অন্যদিকে মধু স্কিনকে উজ্জ্বল করে এবং অলিভ অয়েল ত্বককে ময়েশ্চারাইজড রাখতে সাহায্য করে।
ত্বকের আর্দ্রতা হ্রাস পাওয়া কিন্তু ত্বকের সংবেদনশীল হয়ে অথার পেছনে একটা বড় কারণ। অনেকের একটা ধারনা আছে যে অয়েলি স্কিনে ময়েশ্চারাইজার লাগানোর দরকার হয়না, এ’ধারনা খুব ভুল। সব রকমের স্কিন টাইপেই তার আর্দ্রতা বজায় রাখাটা ভীষণ প্রয়োজন; আর ত্বক যদি সেনসিটিভ হয় তাহলে তো বেশি করে ময়েশ্চারাইজ করা দরকার। ময়েশ্চারাইজার আপনার ত্বকের ওপরে একটা প্রটেকশন লেয়ার তৈরি করে দেয় যাতে বাইরের ধুলো, ময়লা, ধোঁয়া, দূষণ, সূর্যের ক্ষতিকর উইভি রশ্মি এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ থেকে ত্বককে রক্ষা করা যায়। এছাড়া ময়েশ্চারাইজার ত্বকের রুক্ষতা দূর করে ত্বককে নরম করতে সাহায্য করে যার ফলে ইনফেকশন এবং র্যাশের আশঙ্কা কমে যায়।
কেমিক্যালযুক্ত যে কোন প্রোডাক্ট থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয়, বিশেষ করে যে সব প্রডাক্টে অ্যালকোহল, অ্যালফা হাইড্রক্সি, ইউরিয়া কিম্বা রেটিনালের মতো রাসায়নিক রয়েছে। যে কোন রকম মেকআপ কিম্বা বিউটি প্রোডাক্ট কেনার আগে ভালো করে একবার উপকরণের তালিকা দেখে নেবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, যত কম উপকরণ সেই প্রোডাক্ট ততো বেশি ভালো, অর্থাৎ স্কিনের পক্ষে ভালো। উগ্র গন্ধযুক্ত কোন প্রোডাক্ট সেনসিটিভ স্কিনের ক্ষেত্রে ব্যাবহার না করাই ভালো। যদি আপনার কোন গন্ধে অ্যালার্জি নাও থাকে তাহলেও উগ্র গন্ধের কোন পারফিউম কিম্বা ফেশ ওয়াশ বা অন্য কোন বিউটি প্রোডাক্ট ব্যাবহার করা উচিত না। এতে রাসায়নিক পদার্থ বেশি পরিমানে থাকে যা আপনার ত্বককে আরও বেশি সংবেদনশীল করে তুলতে পারে এবং এতে র্যাশ, চুলকানি কিম্বা ব্রনর মতো নানা ধরনের ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
যাদের ত্বক সেনসিটিভ তাঁরাই একমাত্র বোঝেন যে মেকআপ কিম্বা বিউটি প্রোডাক্ট কেনাটা তাদের কাছে কতটা অসুবিধেজনক। যতটা সম্ভব কেমিক্যাল-ফ্রি এবং অরগানিক প্রোডাক্ট ব্যাবহার করুন। যেসব সাবান, ক্রিম, ফেস ওয়াশ কিম্বা শ্যাম্প্যুতে অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় সেগুলো না লাগানোই ভালো, কারণ সেনসিটিভ স্কিনে খুব বেশি রিঅ্যাকশন দেখা যেতে পারে এইসব রাসায়নিক থেকে। চেষ্টা করুন আয়ুর্বেদিক প্রোডাক্ট ব্যবহার করার। প্রাকৃতিক উপাদান যেমন নিম, হলুদ, অ্যালোভেরা, চন্দন ইত্যদি যুক্ত প্রোডাক্ট নিয়মিতভাবে ব্যবহার করুন। হাইপো অ্যালার্জিক স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট বাছুন, যার পি এইচ ব্যালান্স ৫:৫ সেরকম প্রোডাক্ট সেনসিটিভ স্কিনের জন্য ভালো, এতে জ্বালা, লালচে ভাব, চুলকানি কিম্বা অন্য ইনফেকশন হবার আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।
ধরুন নতুন কোন প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে মন চাইছে কিন্তু বুঝতে পারছেন না যে সেটা আপনার ত্বকের সংবেদনশীলতা আরও বাড়িয়ে দেবে কিনা, তাহলে সেটা একবার পরীক্ষা করে নিন। আপনার কানের পিছনে কিম্বা কনুয়ে লাগিয়ে দেখুন, যদি দেখেন যে কোন সমস্যা হচ্ছে না, তাহলে সেই প্রোডাক্টটি কিনতে পারেন। তবে আমি ডারমাটোলজিস্টের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোন প্রোডাক্ট ব্যবহার করিনা।
স্কিন টাইপ নর্মাল হোক কিম্বা অয়েলি অথবা সেনসিটিভ, দিনের বেলা কিন্তু সানস্ক্রিন লাগানোটা জরুরি। আপনি বাড়ি থেকে বেরন কিম্বা না বেরন, সানস্ক্রিন লাগাতে একেবারেই ভুলবেন না। আর আপনার ত্বক যদি সেনসিটিভ হয় তাহলে এস পি এফ ৩০ কিম্বা তার বেশি এস পি এফ যুক্ত সানস্ক্রিন লাগান। এতে আপনার ত্বকের ওপরে একটা প্রোটেকশন লেয়ার তৈরি হবে যা বাইরের দূষণ থেকে আপনার ত্বক রক্ষা করবে।
ত্বক সেনসিটিভ বলে কি একটু সাজগোজ করবেন না? নিশ্চই করবেন। ব্যস ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা বিষয় মাথায় রেখে মেকআপ করুন না, কে বারন করেছে! মিনেরালযুক্ত ফেস পাউডার এবং সিলিকন বেসড ফাউন্ডেশন ব্যবহার করুন, এতে স্কিনে কম রিঅ্যাকশন হয়। যাদের স্কিন সেনসিটিভ তাদের পক্ষে লিক্যুইড আইলাইনারের বদলে পেন্সিল আইলাইনার ভালো, কারণ লিক্যুইড আইলাইনারে ল্যাটেক্স নামক একটি পদার্থ থাকে যা স্কিনে ইরিটেশন ঘটাতে পারে।
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!
এগুলোও আপনি পড়তে পারেন