বাড়িতে মৌরি মজুত রেখেছেন? তা হলে আর শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন নেই! এই প্রাকৃতিক উপাদানটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ফাইবার, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং সোডিয়াম। মজুত রয়েছে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক এবং নিয়াসিনের মতো খনিজও। রয়েছে ভিটামিন কে এবং ভিটামিন বি। এত সব খনিজ এবং ভিটামিন যদি নিয়মিত আপনাদের শরীরে ঢুকতে শুরু করে, তা হলে বুঝতেই পারছেন শরীর নিয়ে আর কোনও চিন্তাই থাকবে না।
মৌরি নিয়ে সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর
নিয়মিত মৌরি খাওয়ার উপকারিতা (Benefits of Eating Fennel Seeds Regularly)
নিয়মিত মৌরি খাওয়া (Amazing Benefits of Fennel In Bengali) শুরু করলে শরীরে নানা খনিজ এবং ভিটামিনের ঘাটতি দূর হয়। মেলে আরও কিছু উপকার।
১| হজমের উন্নতি (Helps In Improving Digestion)
খাবার খাওয়ার পরে মুখশুদ্ধি হিসেবে মৌরি খান। দেখবেন, গ্যাস-অম্বল আর ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারবে না। এমনকী, বুক জ্বালা বা অম্বলের মতো সমস্যাও দূরে পালাবে। কেন এত উপকার মিলবে জানেন? কারণ, মৌরিতে রয়েছে বেশ কিছু এসেনশিয়াল তেল, যা রক্তে মিশে যাওয়া মাত্র পাচক রসের ক্ষরণ বাড়ে। সঙ্গে পেট (stomach) এবং অন্ত্রের (intestine) প্রদাহও কমায়। যার ফলে খাবারে উপস্থিত নানা পুষ্টিকর উপাদান যেমন শরীরে ঠিক মতো মিশে যাওয়ার সুযোগ পায়, তেমনই হজমের ক্ষমতাও বাড়ে। অন্য দিকে মৌরিতে থাকা ফাইবার, কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দূর করে। কমায় নানা পেটের রোগের প্রকোপও।
২| হাঁপানির চিকিৎসায় কাজে আসে (Treats Asthma)
মৌরিতে (fennel) আছে বিশেষ কিছু “ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট”, যা সাইনাসের প্রকোপ কমায়। সঙ্গে হাঁপানির চিকিৎসাতেও কাজে আসে। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু সমীক্ষা অনুসারে, মৌরি ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ায় এবং ব্রঙ্কাইটিসের প্রকোপ কমাতেও সাহায্য করে। তবে একটা কথা মাথায় রাখা উচিত যে, হাঁপানি এবং ব্রঙ্কাইটিসের প্রথাগত চিকিৎসার পাশাপাশি এই ঘরোয়া টোটকাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র মৌরির সাহায্যে এমন সব রোগের চিকিৎসা করার আগে এক বার ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া উচিত।
৩| মুখের দুর্গন্ধ দূর হয় (Prevents Bad Breath)
মুখ থেকে বাজে গন্ধ বেরলে লোকসমাজে নিজেই লজ্জায় পড়বেন! তাই এবার থেকে এমন সমস্যা হলেই মৌরি খাওয়া শুরু করুন। দেখবেন, ঝটপট উপকার মিলবে। মৌরি খাওয়ামাত্র মুখে লালার (saliva) নিঃসরণ বেড়ে যায়, যা দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে আর দাঁতের ফাঁকে থাকতে দেয় না। সেই সঙ্গে এই প্রাকৃতিক উপাদানে (fennel) উপস্থিত বেশ কিছু অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান নিমেষে জীবাণুদের মেরে ফেলে। ফলে মুখ থেকে দুর্গন্ধ বেরনোর আশঙ্কা আর থাকে না।
৪| খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে (Reduces Bad Cholesterol)
২০১৮ সালে জার্নাল অফ দি আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিয়োলজিতে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুসারে আমাদের দেশের কমবয়সিদের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্তের সংখ্যা আগের চেয়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন পরিস্থিতির পিছনে স্ট্রেস এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনকেই দায়ী করছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, সারাক্ষণ নানা চাপের মধ্যে থাকার কারণেই রক্তচাপ বাড়ছে। বাড়ছে কোলেস্টেরলও, যা এক সময়ে গিয়ে হার্টের মারাত্মক ক্ষতি করে দিচ্ছে। তাই জীবনযাত্রা পরিবর্তনের পাশাপাশি, সকলেরই নিয়মিত মৌরি খাওয়া উচিত! কারণ, এতে রয়েছে ফাইবার, যা শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রাকে কমিয়ে ফলে। তাই হার্টের কোনও ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আর থাকে না (fennel and heart)।
৫| রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে (Controls Blood Pressure)
মৌরিতে আছে প্রচুর মাত্রায় পটাসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম। এই দুই খনিজ রক্তে সোডিয়ামের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে (health)। ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা আর থাকে না। এতে উপস্থিত ম্যাগনেসিয়ামও এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই যাঁদের পরিবারে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে, তাঁদের তো নিয়মিত মৌরি খাওয়া উচিত।
৬| ওজন কমে (Helps To Reduce Weight)
বলেন কি, মৌরি খেলে ওজন কমবে? নিশ্চয়ই! কারণ, এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, যা অনেকক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখে। ফলে খাবার খাওয়ার ইচ্ছে কমে। আর কম খেলে তো ওজন কমবেই। তবে আরও এক ভাবে মৌরি ওজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। এতে থাকা বিশেষ কিছু উপাদান, প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যায়। সঙ্গে হজম ক্ষমতারও উন্নতি ঘটে। ফলে দেহের ইতি-উতি মেদ জমার আশঙ্কাও আর থাকে না।
৭| অনিদ্রার সমস্যা দূর হয় (Helps To Treat Insomnia)
রাতে কি আপনার একেবারেই ঘুম আসে না? তা হলে কিন্তু চিন্তার বিষয়। কারণ, ঠিকমতো ঘুম না হলে শরীর আর ব্রেন আরাম পাবে না। ফলে এক নয়, একাধিক রোগ ঘাড়ে চেপে বসার আশঙ্কা বাড়বে। তা হলে উপায়? চিন্তা কীসের, হাতের কাছে মৌরি আছে তো? প্রতিদিন ঘুমতে যাওয়ার আগে অল্প করে মৌরি খাওয়া অভ্যেস করুন। দেখবেন, ঘুমে আর ব্যাঘাত ঘটবে না। কারণ, এতে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, যা অনিদ্রার সমস্যা দূর করতে নানাভাবে সাহায্য করে।
৮| ডায়াবেটিসের সঙ্গে লড়াই করে (Fight with Diabetes)
কোন খাবার খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ার আশঙ্কা আছে, তা নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একটি তালিকা তৈরি করেছেন, যার পোশাকি নাম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (Glysemic Index)। এই তালিকার একেবারে নীচের দিকে আছে মৌরি। তাই ডায়াবেটিকরা নিশ্চিন্তেই এটা খেতে পারেন। নিয়মিত মৌরি খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা তো কমবেই, সঙ্গে ডায়াবেটিস সম্পর্কিত নানা সমস্যাও দূরে পালাবে। কারণ, মৌরিতে আছে ভিটামিন সি এবং বিটা-ক্যারোটিন, রয়েছে একাধিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও, যা রক্তে শর্করার পরিমাণ যাতে বেড়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখে।
গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে এই মারণ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে-লাফিয়ে বেড়েছে। তাই তো আজ ভারত দেশ বিশ্বের ডায়াবেটিস ক্যাপিটালে পরিণত হয়েছে! এমন পরিস্থিতিতে ছোট-বড় সকলেরই যে নিয়মিত মৌরি খাওয়ার প্রয়োজন বেড়েছে, তা আর বলার আপেক্ষা রাখে না।
৯| বন্ধ্যাত্বের সমস্যা দূরে থাকে (Prevents Infertility)
আয়ুর্বেদিক বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত মৌরি ভেজানো জল খেলে শরীরে ইস্ট্রোজেনিক হরমোনের পরিমাণ বাড়ে। তাই বন্ধ্যাত্বের মতো সমস্যা নাকি ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারে না। তবে এক্ষেত্রে ঘরোয়া চিকিৎসার পাশাপাশি আধুনিক চিকিৎসারও প্রয়োজনও আছে। তাই শুধু মৌরির উপর ভরসা করেই বসে থাকবেন না।
ত্বক ও চুলের যত্নে মৌরি (Benefits of Fennel Seeds for Skin and Hair)
মৌরি শুধু শরীরকে চাঙ্গা করে না। ত্বক এবং চুলের যত্নেও নানাভাবে কাজে আসে।
১| ব্রণর প্রকোপ কমায় (Cures Pimples & Acne)
মেয়েদের কাছে ব্রণ মানেই দুঃস্বপ্ন! কিন্তু জনেন কি, আপনার হাতের কাছেই আছে এমন এক ব্রহ্মাস্ত্র, যা ব্রণর প্রকোপ কমাতে দারুণ কাজে আসে? সেই ব্রহ্মাস্ত্র হল মৌরি। নিয়মিত মৌরি খাওয়া শুরু করলে শরীরে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং এবং অ্যান্টিসেপটিক উপদানের পরিমাণে বাড়তে শুরু করে, যার প্রভাবে ব্রণ সৃষ্টিকারী সব ব্যাকটেরিয়া মারা পড়ে। ফলে ব্রণ কমে যায় নিমেষে।
২| চুল পড়ার হার কমে (Reduces Hair Fall)
একটা বাটিতে দু’ কাপ জল নিয়ে তাতে দু’-তিন চামচ মৌরি ফেলে জলটা ফুটিয়ে নিন। জলটা ঠান্ডা হলে সেই জলে চুল ধুয়ে নিন। নিয়মিত এই ভাবে চুলের যত্ন নিলে চুলের গোড়া শক্ত হবে, পুষ্টির ঘাটতিও মিটবে। ফলে চুল পড়া তো কমবেই, সঙ্গে চুলের জেল্লাও বাড়়বে।
৩| স্ক্যাল্প আর্দ্র থাকে (Moisturize Dry Scalp)
মাথার ত্বকের আর্দ্রতা কমলেই বিপদ! কারণ, এমন পরিস্থিতিতে খুশকি সহ আরও হাজার রকমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাড়তে পারে চুল পড়াও। তাই স্ক্যাল্প আর্দ্র রাখা মাস্ট! আর সেই কারণেই প্রয়োজন পড়বে মৌরির। দু’-তিন চামচ মৌরিগুঁড়োর সঙ্গে এক চামচ দই মিশিয়ে একটা পেস্ট তৈরি করে নিন। এবার সেই মিশ্রণটা ধীরে-ধীরে স্ক্যাল্পে লাগিয়ে মালিশ করুন। ১৫-২০ মিনিট পরে ধুয়ে ফেলুন চুল। সপ্তাহে দু’-তিন দিন এভাবে চুলের পরিচর্যা করলে উপকার মিলবে হাতে-নাতে!
৪| ত্বকের জেল্লা বাড়ায় (Good for Glowing Skin)
এক বাটি গরম জলে এক চামচ মৌরি ফেলে মিনিটকুড়ি ফোটান। জলটা একটু ঠান্ডা করে, সেই জলে দু-তিন ড্রপ টি ট্রি তেল ফেলে ভালে করে মিশিয়ে নিন। এরপর একটা তুলো নিয়ে সেই জলে ভিজিয়ে সারা মুখে ভালে করে লাগিয়ে কিছুক্ষণ মালিশ করুন। দিনে তিন-চার বার এই জল মুখে লাগালে ত্বকের জেল্লা তো বাড়বেই, সঙ্গে লোমকূপের ভিতরে জমে থাকা ময়লাও ধুয়ে যাবে (skin care)।
৫| ত্বকের বয়স কমবে (Prevents Ageing)
খাতায়-কলমে বয়স বাড়ুক, ক্ষতি নেই! ত্বকের বয়স না বাড়লেই হল! আর তাই তো ত্বকের যত্নে মৌরির ব্যবহার মাস্ট! কারণ, বলিরেখা কমাতে এবং স্কিন টোনের উন্নতিতে এই প্রাকৃতিক উপাদানটি নানাভাবে কাজে আসে। এক্ষেত্রে এক বাটি জলে দুই চামচ মৌরি নিয়ে জলটা হলকা আঁচে ১৫ মিনিট ফোটাতে হবে। জলটা ঠান্ডা হলে তাতে এক চামচ দই ভাল করে মিশিয়ে নিতে হবে। এবার সেই মিশ্রণটা মুখে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিটে অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলতে হবে। নিয়মিত এই ফেসপ্যাক মুখে লাগালেই দেখবেন কেল্লা ফতে!
মৌরি নিয়ে সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর (FAQs)
১| মৌরি কি সত্যিই লিভারের জন্য উপকারী?
মৌরিতে আছে সেলেনিয়াম নামে একটি উপাদান, যা লিভার ফাংশনের উন্নতি ঘটায়। সঙ্গে লিভারে উপস্থিত টক্সিক উপাদানও বের করে দেয়। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির ক্ষমতা বাড়তে সময় লাগে না।
২| দিনে কতটা করে মৌরি খাওয়া উচিত?
প্রতিদিন পাঁচ-সাত গ্রামের বেশি মৌরি না খাওয়াই ভাল।
৩| নিয়মিত মৌরি খেলে কি কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে?
না, তেমন কিছু হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে বেশি পরিমাণে খেলে কারও-কারও পেট খারাপ হতে পারে। এমনকী, অ্যালার্জি হওয়ার আশঙ্কাও থাকে (fennel side effects)। তাই মেপে খাওয়াই ভাল।
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!