খুব ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বাবার পরিচিত এক বিদেশী বন্ধু বলেছিলেন, বাঙালির শিল্পপ্রীতি দেখতে গেলে যে কোনও একটা বাঙালি বিয়ে অ্যাটেন্ড করো। কারণ এখানে শুরু থেকে শেষ সবটাই একটা শৈল্পিক ব্যাপার। যথার্থ পর্যবেক্ষণ এই নিয়ে কোনও কথা হবে না।খুব সাধারণ একটা জিনিসের কথাই ধরুন না।কনের বেনারসি (banarasi)। এটা ছাড়া আজ পর্যন্ত বাঙালি বিয়ে ভাবতে পেরেছেন কখনও? যদিও আজকাল অন্য ধরনের শাড়ি, লেহেঙ্গা ইত্যাদি পরার চল হয়েছে। কিন্তু প্রথম স্থান থেকে বেনারসিকে কেউ সরাতে পারেনি।জানেন কি যে মহাভারত এবং বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থেও এই শাড়ির উল্লেখ আছে? এর অর্থ জলের মতো সোজা। বেনারসির ইতিহাস অতি প্রাচীন। বিয়ের সিজন তো আর কিছুদিন পড়েই শুরু হয়ে যাবে আর চলবে টানা ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। তাই হবু কনেদের (bride) কথা চিন্তা করে আমাদের এই প্রতিবেদন। বেনারসি শাড়ির(saree) যে কত রূপ (designs) আর রং হয়, এটা পড়ার পর বুঝতে পারবেন। এটা শুধু একটা পরিধান নয় এটা একটা শিল্পকর্ম। আর শিল্পের সমঝদার হতে গেলে এইটুকু সময় তো দিতেই হবে। কী বলেন?
আমরা সাধারণত বেনারসির কাজ বা রং দেখেই মুগ্ধ হয়ে যাই। কিন্তু বেনারসির আসল বিষয়বস্তু হল তার জমি বা বেস। অর্থাৎ কোন জাতীয় কাপড়ের উপর বেনারসি বোনা হয়েছে। এটা অনেকটা সাদা ক্যানভাসের মতো। কিছু ক্যানভাসে যেমন জলরং ভাল লাগে আবার কিছু ক্যানভাসে তেলরঙ, ঠিক তেমনই বেনারসির মেটিরিয়ালের উপর নির্ভর করে শাড়িটি কেমন হবে।বেনারসি আসলে সিল্কের শাড়ি।বেনারসে যখন এই জাতীয় সিল্ক থেকে শাড়ি বোনা হয় তখন তাকে বেনারসি শাড়ি বলা হয়। শাড়ির মেটিরিয়ালের উপর ভিত্তি করে এখানে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে বেনারসির।
কাতান একটি বিশেষ ধরনের বেনারসি। তবে বেনারসি ছাড়াও অন্যান্য রূপে কাতান শাড়ি বা কাতান সিল্ক পাওয়া যায়।কাতান আসলে এক বিশেষ ধরনের সুতো যা বিভিন্ন রকমের সিল্ক সুতো পেঁচিয়ে তৈরি হয়। মূলত দুটি সিল্কের সুতো পেঁচিয়ে কাতানের সুতো তৈরি হয়। কাতান বেনারসির ফ্যাব্রিক খুব হাল্কা হয়।
স্যাটিন সিল্কের বেসের উপর যদি বেনারসি ডিজাইন করা হয় তাহলে সেটাকেই স্যাটিন বেনারসি বলা হয়। তবে স্যাটিন যদি খাঁটি না হয় তাহলে স্বভাবতই বেনারসির জরির কাজ ভাল করে ফুটে উঠবে না। যেহেতু ফ্যাব্রিক হিসেবে স্যাটিন বেশ ভারী হয় তাই এই জাতীয় বেনারসির ওজন বেশ ভাল হয়।
অরগ্যাঞ্জা বেনারসি প্রকৃতপক্ষে ব্রোকেডের বেনারসি। এখানে শাড়ির বুনন খুব ঘন হয়। অরগ্যাঞ্জা বেনারসি তৈরি করার সময় ওয়ার্প অ্যান্ড ওয়েফট নামক বিশেষ বুনন পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়। এই বেনারসিকে কোরা বেনারসিও বলা হয়। রূপালি সুতোর উপর সোনালি রং করে নেওয়া হয় তারপর খুব ঘন বুননের মাধ্যমে জরি ব্রোকেড তৈরি হয়।
বেনারসির সাম্প্রতিক ডিজাইনের বেশিরভাগ দেখা যায় জর্জেট বেনারসিতে। এটিকে ডিজাইনার শাড়ির পর্যায়ে ফেলা যায়। বিভিন্ন পার্টি এবং অনুষ্ঠানে জর্জেট বেনারসির চাহিদা খুব বেশি।জর্জেট ফ্যাব্রিক খুব হাল্কা হয় এবং এই শাড়ি বুনন পদ্ধতি হয় খুব সহজ। এস এবং জেডের মতো প্যাঁচানো সুতো দিয়ে ওয়ার্প অ্যান্ড ওয়েফট পদ্ধতিতে এই শাড়ি বোনা হয়।
বোঝাই যাচ্ছে এক্ষেত্রে শাড়ির জমি বা বেস হবে তসর। হ্যান্ডলুম বা হাতে তৈরি তসর কিন্তু একটু খসখসে হয়। আর এটাই প্রকৃত তসরের পরিচয়। তাই তসর বেনারসিও একটু খসখসে হবে। এর উপর হাত রাখলে রেশমের মতো অনুভূতি আসবে না।
এখন টিস্যু বেনারসি পরার খুব চল হয়েছে। কারণ এই জাতীয় বেনারসি খুব আকর্ষণীয় হয়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম টিস্যু বেনারসি খুব পছন্দ করে। এই বেনারসি এমনভাবে বোনা হয় যাতে জরির ব্রোকেডের কাজ দেখে মনে হয় সেটা সোনার জরি দিয়ে বোনা হয়েছে। এই শাড়িতে জরি আর সিল্ক দুই মিশিয়ে কাজ হয়।
শাড়ির জমির পরেই যার উপর ভিত্তি করে বেনারসির শ্রেণীবিভাগ করা সম্ভব সেটি হল শাড়ির নকশা বা ডিজাইন। কোনও কোনও বেনারসি খুব ঘন ডিজাইনের হয় আবার কোনও কোনও শাড়িতে থাকে হাল্কা কাজ। এই একেকটি কাজ বা প্যাটার্ন দিয়েও বেনারসি শাড়ি আলাদা করা যায়।
এই শাড়ি কে না পছন্দ করে বলুন দেখি? কারণ এই শাড়ির আকর্ষণই আলাদা। জামদানি আসলে এক বিশেষ ধরনের মসলিন। এখানে দুই রকমের সুতো দিয়ে শাড়ি বোনা হয়। জামদানির কাজ করা বেনারসিতে থাকে সিল্কের ফ্যাব্রিক যার সঙ্গে সুতির ব্রোকেড মেশানো থাকে।
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে খুব ঘন জঙ্গলের মতো কাজ হয় এই শাড়িতে, আর তাই এই ধরনের নামকরণ হয়েছে।জংলা বেনারসিতে নানা রঙের সুতোর ব্যবহার করা হয় আর তাই এই শাড়ি হয় খুব ঝলমলে। গোটা শাড়িতে প্রচুর কাজ করা থাকে।
খুব সূক্ষ্মভাবে বোনা বেনারসি যার উপর বাড়তি সুতো দিয়ে হাল্কা কাজ করা আছে, তাকেই বলে তাঞ্চই বেনারসি। এই জাতীয় বেনারসির বুনন পদ্ধতি খুব জটিল কারণ এখানে এখানে প্রায় পাঁচ রকমের রং ব্যবহার হয়। তাঞ্চই মোটিফের শাড়ি খুব হাল্কা হয় এবং পরতে সুবিধা হয়।বলা হয় যে এই শাড়ি বুনন পদ্ধতি চিন দেশ থেকে এসেছে। চিনের তিন ভাই যাঁদের নামের শেষে ছিল চই শব্দটি, তাঁরা এসে সুরাটের তাঁতিদের এটি সেখান। সেখান থেকে এটি বেনারসে আসে। তিন বা তান আর চই সি দুটি শব্দ মিলে তাঞ্চই শব্দটি এসেছে।
বুটিদার বেনারসিকে অনেক সময় গঙ্গা যমুনা বেনারসিও বলা হয়। কারণ এখানে রূপালি আর সোনালি দুই ধরনের শেডস দেখা যায়।বুটিদার বেনারসি ঘন নীল রঙের হয় এবং এর মধ্যে থাকে সিল্ক, সোনা ও রূপার জরির সুতো। খুব গাঢ় রং হয় আর সেখানে দুটো শেড দেখা যায় বলে শাড়িটি দেখতে খুব সুন্দর লাগে।বুটিরও নানা রকম প্রকারভেদ দেখা যায়। যেমন আশরফি বুটি, লতিফা বুটি, রেশম বুটি, ঝুমর বুটি ইত্যাদি।
অন্যান্য শাড়িতে যেমন কাটওয়ার্ক পদ্ধতি দিয়ে তৈরি করা হয় কাটওয়ার্ক বেনারসির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। এখানে প্লেন বা সাদামাটা টেক্সচারের উপর সুতো তুলে তুলে করা হয়। এই শাড়ি দেখতে খুব ঝলমলে হয় এবং ট্রান্সপারেন্ট হয়।
এই জাতীয় বেনারসি খুব উজ্জ্বল হয়। এই শব্দটি এসেছে কড়া হুয়া শব্দদ্বয় থেকে। যার অর্থ হল এমব্রয়ডারি করা। কারণ এখানে যে ধরনের সুতো ব্যবহার করা হয় সেটি এমব্রয়ডারি করা থাকে, তাই এইরকম নামকরণ করা হয়েছে। সনাতনী তাঁতে এই শাড়ি বুনতে হয় এবং একেকটি শাড়ি বুনতে প্রায় দুই মাস সময় লাগে।
এটি একটি অন্য ধারার নকশা। একে জরি ভাসকেট বা বাস্কেট আর্ট বলা হয়। সম্ভবত বেতের ঝুড়ি বা অন্যান্য বস্তু যেভাবে বোনা হয় সেই একই পদ্ধতি এখানেও প্রয়োগ করা হয় বলে এহেন নামকরণ হয়েছে। বেশিরভাগ বাস্কেট জরি বেনারসিতে অ্যানিমেল মোটিফ থাকে এবং মিনাকারি স্টাইলে এই শাড়ির নকশা করা হয়।
এটি একটি বিশেষ রকমের কারুকার্য। এই ধরনের কারুকার্য যদি বেনারসি শাড়িতে দেখা যায় তাহলে সেটাকে জারদৌসি বেনারসি বলা হবে।জারদৌসি আসলে খুব ঘন করে করা এমব্রয়ডারি যা মেটালিক বা ধাতব সুতো ব্যবহার করে করা হয়। এই জাতীয় সুতোকে বলা হয় বুলিয়ন সুতো, ফ্রেঞ্চ ওয়্যার বা মেটালিক স্প্রিং থ্রেড। এই সুতো চকচকে হয় এবং প্যাঁচানো হয়। আর যেহেতু এটি ধাতব সুতো তাই সোনালি ও রূপালি এই দুটি শেড এই শাড়িতে দেখা যায়।
বেনারসির শ্রেণীবিভাগ করা হয় রঙের উপর ভিত্তি করেও। সবচেয়ে বেশি বেনারসি দেখা যায় লাল রঙের। এছাড়াও নানা উজ্জ্বল রঙের বেনারসি আছে। লালের পরেই আছে নীলের স্থান।তবে রং যাই হোক না কেন বেনারসির জরির কাজ দেখেই এই শাড়ি স্বতন্ত্রভাবে চিনে নেওয়া যায়।
কনের শাড়ি মানেই লাল বেনারসি! যুগ যুগ ধরে এটাই চলে আসছে। তবে লালেরও নানা রকম শেড আছে। যেমন হাল্কা বা গাঢ় লাল। আবার শেড ছাড়াও তারতম্য দেখা যায় কাজ বা নকশাতেও।কিছু লাল একটু মেরুন ঘেঁষা হয় আবার কিছু লাল হয় একটু কমলা ঘেঁষা। তবে বুটি দেওয়া এবং জমকালো আঁচলের লাল বেনারসিই মেয়েদের বেশি পছন্দ এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
এই ধরনের বেনারসি শাড়ি পরে যেতে পারেন সকালের যে-কোনও অনুষ্ঠানে কিংবা সন্ধেবেলার ছোট পার্টিতেও! এই শাড়ি হালকা, সামলাতে সুবিধে। পাওয়া যায় যে-কোনও প্যাস্টেল শেডে। হালকা সাজ, ছিমছাম গয়না আর চুলে জুঁই কিংবা বেল ফুলের মালা, সকলের মধ্যে আপনি নজর কাড়বেনই!
আধুনিকা সাজতে চান, কিন্তু ট্র্যাডিশনকে মাথায় রেখেই? তা হলে বেছে নিন এই ধরনের রংয়ের শাড়ি। আসমানি নীল, হালকা গোলাপি, মিষ্টি পিচ, একেবারে ঝিমিয়ে পড়া কমলা, এই রংগুলো আপনার জন্যই তৈরি হয়েছে। অথচ শাড়ির মোটিফে আছে সনাতনী বেনারসির ছোঁওয়া। এর সঙ্গে পরুন ফিনফিনে স্লিভলেস ব্লাউজ, চুল বাঁধুন টেনে, কপালে ছোট্ট টিপ আর গাঢ় করে কাজল দিন চোখে! এবার আপনাকে ফ্যাশনিস্তা বলবে না, এমন বুকের পাটা ক'জনার আছে!
মাল্টি শেডের বেনারসি এখন কিন্তু খুব ইন। একই রংয়ের হালকা এবং গাঢ়র কম্বিনেশনে তৈরি হয় এই শাড়িগুলি। এখানে যেমন জাম রংয়ের দু'টি শেড ব্যবহার করা হয়েছে। এই ধরনের জমকালো শাড়ি পরলে কিন্তু সাজ হবে একদম হালকা। কানে একটা ঝোলা দুলই যথেষ্ট।
পাটোলা সিল্কের বেনারসি বাজারে নতুন। সর্বত্র পাওয়াও যায় না। কিন্তু দারুণ সুন্দর আর ভারী হালকা। এই ধরনের শাড়ি পরলে বাছুন একদম হালকা রং, সাদা কিংবা অফ হোয়াইট। সঙ্গে ব্লাউজ পরতে পারেন যে-কোনও গাঢ় রংয়ের। আঁচল প্লিট করে নিন কিংবা ছেড়ে রাখুন। অ্যাকসেসরাইজ করুন মুক্তোর গয়না দিয়ে। আভিজাত্যপূর্ণ সাজ।
যদি আপনি খাঁটি আধুনিকা হয়ে থাকেন, তা হলে বেছে নিন কালো কিংবা নেভি ব্লু গোছের গাঢ় রংয়ের জর্জেট বেনারসি! সঙ্গী হোক অক্সিডাইজড গয়না। স্নিগ্ধ, রুচিশীল সাজে পার্টি মাতাতে আর কি চাই?
উত্তর: দুটোই সিল্কের শাড়ি। তবে শাড়ির উৎস একদমই আলাদা। কাঞ্জিভরম দক্ষিণ ভারতীয় শাড়ি এবং বেনারসি উত্তর ভারতীয়।
উত্তর: কাতান আসলে এক বিশেষ ধরনের সুতো। দুটি সুতো একসঙ্গে পেঁচিয়ে কাতান সুতো তৈরি হয়। এই জাতীয় সুতো দিয়ে বোনা বেনারসিকে বলা হয় কাতান বেনারসি।
উত্তর: কড়িয়াল এক ধরনের সিল্ক শাড়ি। এর দুটি প্রকার আছে। একটি হল গরদ কড়িয়াল যেটি গরদ শাড়ির উন্নত রূপ এবং অপরটি হল কড়িয়াল বেনারসি, যেখানে বেনারসি বুনন পদ্ধতি দেখা যায়।কড়িয়াল বেনারসি মূলত অফ হোয়াইট হয়।
উত্তর: হ্যাঁ, সব বেনারসি শাড়িতেই ব্লাউজ পিস থাকে।
উত্তর: হ্যাঁ। কারণ, বেনারসি শাড়িতে সুতোর কাজ থাকে। নেটিং বা পাতলা জাল দেওয়া থাকলে সেই সুতো দীর্ঘদিন অক্ষত থাকে।
Featured Image: Melange Singapur
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!
এসে গেল #POPxoEverydayBeauty - POPxo Shop-এর স্কিন, বাথ, বডি এবং হেয়ার প্রোডাক্টস নিয়ে, যা ব্যবহার করা ১০০% সহজ, ব্যবহার করতে মজাও লাগবে আবার উপকারও পাবেন! এই নতুন লঞ্চ সেলিব্রেট করতে প্রি অর্ডারের উপর এখন পাবেন ২৫% ছাড়ও। সুতরাং দেরি না করে শিগগিরই ক্লিক করুন POPxo.com/beautyshop-এ এবার আপনার রোজকার বিউটি রুটিন POP আপ করুন এক ধাক্কায়...