শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ – ১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮) ছিলেন একজন বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক, ও গল্পকার। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় এবং বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তাঁর অনেক উপন্যাস ভারতবর্ষের প্রধান ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্য়ায়ের উপন্যাস (Novels By Sarat Chandra Chattopadhyay) নিয়েই এই প্রতিবেদন। তার মধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Sarat Chandra Chattopadhyay) এর প্রেমের উপন্যাসের উল্লেখও রয়েছে। বস্তুত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর জীবনী এখনও স্কুল পাঠ্যের অন্তর্গত।
ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি বিভাগের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। পাঁচ ভাই আর বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। তার দিদি অনিলা দেবী ছাড়াও প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে তার দুই ভাই ও সুশীলা দেবী নামে তার এক বোন ছিল। শরৎচন্দ্রের ডাকনাম ছিল ন্যাঁড়া। দারিদ্র্যের কারণে মতিলাল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন বলে শরৎচন্দ্রের শৈশবের অধিকাংশ সময় এই শহরেই কেটেছিল
শরৎচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়সকালে মতিলাল তাকে দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন, যেখানে তিনি দু-তিন বছর শিক্ষালাভ করেন। এরপর ভাগলপুর শহরে থাকাকালীন তার মামা তাকে স্থানীয় দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তিতে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মতিলালের ডিহিরির চাকরি চলে গেলে তিনি তার পরিবার নিয়ে দেবানন্দপুরে ফিরে গেলে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই সময় তিনি হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে দারিদ্র্যের কারণে স্কুলের ফি দিতে না-পারার কারণে তাকে এই বিদ্যালয়ও ত্যাগ করতে হয়। এই সময় তিনি ‘কাশীনাথ’ ও ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে দুটি গল্প লেখেন। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মতিলাল পুনরায় ভাগলপুর ফিরে গেলে প্রতিবেশী সাহিত্যিক তথা তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষালাভের প্রতি শরৎচন্দ্রের আগ্রহ লক্ষ করে তাকে তার বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এই বিদ্যালয় থেকে ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করে তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হন। এই সময় তিনি তার মাতামহের ছোটো ভাই অঘোরনাথের দুই পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে প্রতি রাতে পড়াতেন, তার বিনিময়ে অঘোরনাথ তার কলেজে পড়ার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতেন। এতৎসত্ত্বেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না-পারার জন্য তিনি পরীক্ষায় বসতে পারেননি।
শরৎচন্দ্র বার্মা রেলের হিসাব পরীক্ষক হিসেবে পচাত্তর টাকা মাইনের কেরেনিগিরির চাকরি লাভ করেন ১৯০৫ সালে। রেঙ্গুনের উপকণ্ঠে বোটাটং পোজনডং অঞ্চলে কলকারখানার মিস্ত্রিদের পল্লিতে বসবাস করতেন। তার বাসার নিচে শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যা বসবাস করতেন। তার পিতা তার সঙ্গে এক মদ্যপের বিয়ের ঠিক করলে শান্তি দেবী শরৎচন্দ্রকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করায় শরৎচন্দ্র তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। তাদের এক পুত্র সন্তানেরও জন্ম হয়, কিন্তু রেঙ্গুনের প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও তার এক বছরের সন্তান মৃত্যুবরণ করেন। এর অনেক কাল পরে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে কৃষ্ণদাস অধিকারী নামে এক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তির অনুরোধে তার ১৪ বছরের কন্যা মোক্ষদাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি মোক্ষদার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তারা নিঃসন্তান ছিলেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপুল লেখনী ভান্ডার থেকে বেস্ট সেলিং কয়েকটি বই নিয়ে (Sarat Chandra Chattopadhyay Novels In Bengali) এই প্রতিবেদনে আলোচনা করা হল, তার মধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর প্রেমের উপন্যাসের উল্লেখও রয়েছে।
দেবদাস (Devdas)
দেবদাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি প্রণয়ধর্মী বাংলা উপন্যাস (Sarat Chandra Chattopadhyay Best Novels)। দেবদাস শরৎচন্দ্রের প্রথম দিকের উপন্যাস। রচনার সমাপ্তিকাল সেপ্টেম্বর ১৯০০। কিন্তু প্রকাশনার বছর ১৯১৭।
উপন্যাসে দেবদাস বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৎকালীন ব্রাহ্মন জমিদার বংশের সন্তান,পার্বতী এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে৷ বাংলার তালসোনাপুর গ্ৰামে এই দুই পরিবারের পাশাপাশি বাস। ছোটবেলা থেকেই দেবদাস ও পার্বতীর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব যা পরবর্তীতে প্রেমের রূপ নেয়।
কৈশোরে উত্তীর্ণ দুজন হঠাৎই অনুভব করে, তাদের বাল্যকালের বন্ধুত্ত্ব আরও গভীর কিছুতে উত্তীর্ণ হয়েছে। দেবদাস দেখে যে তার ছোটবেলার পারো বদলে গেছে। পার্বতী তাদের কৈশোরের প্রেম বিবাহবন্ধনে পরিস্ফুটনের কথা ভাবে। প্রচলিত সামাজিক রীতি অনুযায়ী, পার্বতীর বাবা-মাকে দেবদাসের বাবা-মায়ের কাছে তাদের বিবাহের প্রস্তাব আনতে হবে। পার্বতীর মা দেবদাসের মা হরিমতির কাছে বিয়ের প্রস্তাব আনলে তিনি আনন্দিত হলেও পাশের বাড়ির সাথে এই সম্পর্ক রাখতে তিনি বিশেষ উৎসাহী হন না। এতে পার্বতীর পিতা নীলকন্ঠ চক্রবর্তী অপমানিত বোধ করেন ও পার্বতীর জন্য আরও ধনী গৃহে বিয়ে ঠিক করেন। পার্বতী একথা জানলে দেবদাস (Sarat Chandra Chattopadhyay Novels In Bengali) অন্তত তাকে গ্ৰহণ করবে এই আশায় রাতের অন্ধকারে তার সাথে দেখা করে। দেবদাস মনস্থির করে তার বাবাকে বললে, তিনি অরাজি হন (Best Bengali Novels)। বিভ্রান্ত অবস্থায়, দেবদাস বাড়ি থেকে কলকাতায় পালিয়ে যায়। সে চিঠি লিখে পার্বতীকে জানায় যে সে এই সম্পর্ক আর রাখতে চায় না।
দেবদাস কলকাতায় ফিরে যায় ও পার্বতীর হাতিপোতা গ্ৰামে ভুবন চৌধুরী নামে এক জমিদারের সাথে বিয়ে হয়। ভুবন চৌধুরীর পূর্বের স্ত্রী মারা গেছেন ও তার তিনজন সন্তান রয়েছে, যারা পার্বতীর প্রায় সমবয়সী বা তার চেয়ে বড়ো। কলকাতায় গিয়ে দেবদাসের চুনীলালের সাথে বন্ধুত্ব হয় ও তার মাধ্যমে সে চন্দ্রমুখী নামে এক বাঈজীর সাথে পরিচিত হয়। সে দেবদাসের প্রেমে পড়ে, যদিও দেবদাস তাকে ঘৃণা করতে থাকে। হতাশাগ্ৰস্ত দেবদাস অত্যধিক মদ্যপান শুরু করলে তার শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়ে। চন্দ্রমুখী তার দেখভাল করতে থাকে। দেবদাস তার মনে প্রতিনিয়ত পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর তুলনা করতে থাকে ও চন্দ্রমুখীকে সে পারোর কথা বলে। দুঃখ ভুলতে দেবদাস ক্রমশ মদ্যপানের মাত্রা বাড়াতে থাকে ও তাতে তার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে। চন্দ্রমুখী বুঝতে পারে যে দেবদাসের ভিতরের আসল মানুষটির আজ পতন ঘটেছে (Bengali Novels)। দেবদাস শেষপর্যন্ত চন্দ্রমুখীর প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়। শীঘ্র আসন্ন মৃত্যুর কথা অনুভব করতে পেরে দেবদাস, পারোকে দেওয়া তার পূর্বের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে হাতিপোতা গ্ৰামে পার্বতীর কাছে রওনা হয়। পার্বতীর বাড়ির সামনে পৌঁছে, এক অন্ধকার শীতের রাতে দেবদাসের মৃত্যু হয়।
Goodreads Rating: 3.88/5
আরও পড়ুনঃ মে দিবসের কবিতা ও স্লোগান
পরিণীতা (Parineeta)
পরিণীতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বাংলা উপন্যাস (Sarat Chandra Chattopadhyay Best Novels)। বইটি ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম সময়ের ভারতের কলকাতার পটভূমিতে উপন্যাসটি রচিত হয়। এর গল্প অবলম্বনে হিন্দি, বাংলা, তামিল ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
Goodreads Rating: 3.93/5
শ্রীকান্ত (Srikanta)
শ্রীকান্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি জীবনচরিত মূলক উপন্যাস। তিনি এই উপন্যাসটি মোট চার খণ্ডে সমাপ্ত করেন। চারটি খণ্ড একসাথে লেখেননি। যথাক্রমে ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯২৭ এবং ১৯৩৩ সালে চারটি খণ্ড লেখা শেষ করেন। ১৩২২ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস থেকে ১৩২৩ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস পর্যন্ত মোট তেরোটি সংখ্যায় ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকায় শ্রীকান্তর ভ্রমণ কাহিনী নামে এই উপন্যাস প্রকাশিত হয় (Sarat Chandra Chattopadhyay Best Novels)। মাঘ ও ফাল্গুন মাসের সংখ্যায় লেখকের নাম হিসেবে লেখা হয় শ্রী শ্রীকান্ত শর্মা। পরের দুইটি সংখ্যায় লেখকের নাম শ্রীশরচ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অবশিষ্ট সংখ্যাগুলিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Sarat Chandra Chattopadhyay) থাকে। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি ভারতবর্ষ পত্রিকার মালিক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স এই তেরোটি সংখ্যায় প্রকাশিত রচনা নিয়ে শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব নাম দিয়ে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। ১৩২৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাস থেকে ১৩২৫ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাস পর্যন্ত ভারতবর্ষ পত্রিকায় শ্রীকান্তর ভ্রমণ কাহিনী আবার প্রকাশিত হয়। এই সময় ১৩২৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন ও কার্তিক মাস এবং ১৩২৫ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের সংখ্যায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় (Sarat Chandra Chattopadhyay Best Novels)। এই রচনাংশ নিয়ে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স শ্রীকান্ত দ্বিতীয় পর্ব নাম দিয়ে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন (Sarat Chandra Chattopadhyay Novels In Bengali)। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের পৌষ মাস থেকে ১৩২৮ বঙ্গাব্দের পৌষ মাস পর্যন্ত ভারতবর্ষ পত্রিকায় এই উপন্যাসের তৃতীয় পর্যায় আবার প্রকাশিত হয়। এই সময় ১৩২৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র এবং ১৩২৮ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ, শ্রাবণ, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের সংখ্যায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়নি। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে নবম পরিচ্ছেদ সমাপ্ত হওয়ার পর শরৎচন্দ্র পাঠক ও প্রকাশকের অনুরোধ সত্ত্বেও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে বহুদিন এই পর্বের অসমাপ্ত অংশ শেষ করেননি। পাঁচ বছর পরে আরো ছয়টি পরিচ্ছেদ লেখা হলে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ না করে সরাসরি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স শ্রীকান্ত তৃতীয় পর্ব নাম দিয়ে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাস থেকে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস পর্যন্ত বিচিত্রা পত্রিকায় এই উপন্যাসের চতুর্থ পর্যায় শ্রীকান্ত চতুর্থ পর্ব নামে আবার প্রকাশিত হয়। এই বারোটি সংখ্যা নিয়ে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই মার্চ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। এরপর শরৎচন্দ্র এই উপন্যাসের পঞ্চম পর্ব রচনা করবেন বলে মনে করলেও তিনি তা করেননি।
Goodreads Rating: 4.26/5
চরিত্রহীন (Charitraheen)
১৯০০ এর দশকের প্রথম দিকে বাংলা সমাজ এই উপন্যাসে (Novels By Sarat Chandra Chattopadhyay) দেখানো হয়েছে। গল্পটিতে চারটি নারী চরিত্র রয়েছে – দুটি প্রধান, সাবিত্রী এবং কিরণময়ী, এবং দুটি ছোট চরিত্র, সুরবালা এবং সরোজিনী। সাবেক দুই চরিত্রের (চরিত্রহীন) হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে সব চার চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাবিত্রী চরিত্রটি বিশুদ্ধ, এবং সে তার ভালবাসার মানুষ (সতীশ) এর প্রতি অনুগত। সুরোবালা উপেন্দ্রনাথের স্ত্রী। তিনি তরুণ, ধর্মীয় গ্রন্থগুলিতে অন্ধ বিশ্বাসের দৃষ্টিতে চরিত্র ও চিত্তাকর্ষক। সরোজিনী পাশ্চাত্য শৈলীতে শিক্ষিত। তিনি শেষে সতীশকে বিয়ে করেন। অবশেষে, কিরণময়ীই উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র। তরুণ এবং অত্যন্ত সুন্দর, তিনি খুব বুদ্ধিমান এবং যুক্তিযুক্ত। তবে তার আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাগুলি সর্বদা বিবাহিত বিষয়গুলির তুলনায় স্বামীকে শিক্ষাদান করার জন্য এবং স্বামী-স্ত্রীর শাশুড়ির দ্বারা সর্বদা দমন করা হয়। তিনি উপন্যাস ও উপাখ্যান-উপেন্দ্র এবং দিবাকর-এ তিনজন প্রধান পুরুষকে বিস্মিত ও চিত্তাকর্ষক-কিন্তু এই অবিশ্বাস্য পুরুষদের দ্বারা তার জীবন শেষ পর্যন্ত কমে যায়। তিনজন পুরুষ চারজন নারীর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু বেশিরভাগ সময় তাদের কাজ নারীদের জন্য ক্ষতিকর। তারা অর্পিত, অবিচ্ছেদ্য এবং তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে নয়। উপেন্দ্র প্রথমে কিরণময়েকে সাহায্য করতেন, কিন্তু দিবাকরের সাথে তার সম্পর্কের সবচেয়ে খারাপ দিকটি মনে করে, এবং আসলে দিবাকরের সঙ্গে কিরণময়ীর বাধ্যতামূলক অংশীদার হয়ে ওঠে। দিবাকর দুর্বল-নিখুঁত এবং অপ্রতিভ।
Goodreads Rating: 4.01/5
আরও পড়ুনঃ সেরা বাংলা হাসির সিনেমা
পথের দাবী (Pather Dabi)
পথের দাবী বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক রচিত একটি জনপ্রিয় উপন্যাস (Novels By Sarat Chandra Chattopadhyay)। এ উপন্যাসটি ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের অগস্ট মাসে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক অসাধারণ বিপ্লবী সব্যসাচী ও তার সাথীদের সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে ব্রিটিশ শাসনকালে লিখিত একটি উপন্যাস। যেটি ব্রিটিশ শাসিত ভারতে নিষিদ্ধ হয়েছিল।
পথের দাবী ধারাবাহিক ভাবে বঙ্গবাণী পত্রিকায় বের হত। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল পত্রিকার অফিস। পুলিশ কমিশনারের চিঠি ও নোট অনুযায়ী তদানিন্তন চিফ সেক্রেটারি পথের দাবীকে ‘বিষময়’ বলে উল্লেখ করেন। ১৯২৬ সালের ১১ ডিসেম্বর এডভোকেট জেনারেল ব্রজেন্দ্রনাথ মিত্র মত দেন যে পথের দাবী দেশদ্রোহকর ও বাজেয়াপ্তযোগ্য। ১৯২৭ এর ৪ জানুয়ারি প্রকাশিত গেজেটে পথের দাবী নিষিদ্ধ হয়। সারা দেশ জুড়ে এই নিষিদ্ধকরণ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল। আইনসভাতে সুভাষচন্দ্র বসু ও হরেন্দ্রনাথ চৌধুরী প্রশ্ন তোলে নিষিদ্ধকরণের যৌক্তিকতা নিয়ে।
Goodreads Rating: 4.10/5
দত্তা (Datta)
দত্তা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস (Novels By Sarat Chandra Chattopadhyay)। ১৯১৮ সালে এটি রচনা করা হয়। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয় দত্তার নাট্যরূপ বিজয়া। এর কাহিনি অনেকটা এরকম… বনমালীবাবু গ্রামের বিশাল জমিদার। তার দুই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু জগদীশ মুখুয্যে ও রাসবিহারী, জগদীশ বেশি প্রিয়। বনমালীবাবুর একমাত্র কন্যা বিজয়ার সঙ্গে রাসবিহারী তার পুত্র বিলাসের বিবাহে অত্যন্ত আগ্রহী, কিন্তু বনমালীবাবুর ইচ্ছা অন্যরূপ। তিনি বিজয়ার বিবাহ জগদীশের পুত্র শ্রীমান নরেন্দ্র মুখুয্যে বা নরেনের সাথে দিতে চান। সেজন্য নরেনের বিলেতে ডাক্তারি পড়ার সমস্ত খরচ বহন করেন। বনমালীবাবু ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন, উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে রাসবিহারীও। সেজন্য গ্রামে তাদের একঘরে করার চেষ্টা হয়। গ্রামবাসীর বিরুপ আচরনের জন্য বনমালী কলকাতায় যান এবং কিছুকাল পরে সেখানেই তার অকালমৃত্যু হয়। সেই সুযোগে রাসবিহারী জমিদারীর সমস্ত ভার নেন। বন্ধুবিয়োগে জগদীশও অসুস্থ হন এবং বাস্তুভিটে খানি বন্ধক রেখে জমিদারী থেকে ঋণ নেন। সময়মতো সেই ঋণ শোধ না করার ফলে রাসবিহারী জগদীশের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাকে গৃহচ্যুত করেন। শোকে জগদীশ বাড়ীর ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা্ করে। সেই সময় নরেন বিলেত থেকে ফিরে সেই গ্রামেই এক আত্মীয়ের বাড়ীতে থেকে চিকিত্সা করতে থাকে, গ্রামে তার বিশেষ সুখ্যাতি হয়, চিকিৎসক হিসাবে ও পরোপকারী মানুষ হিসাবেও। কাহিনী বিশেষ মোড় নেয় যখন গ্রামের মানুষের অনেক জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বনমালীকন্যা বিজয়া গ্রামে ফেরে। এসেই বিজয়া বুঝতে পারে যে জমিদারি দেখাশোনার নামে রাসবিহারী ও তার ছেলে বিলাস সকল ব্যাপারেই বিশেষ আধিপত্য খাটিয়ে চলেছে। প্রথমেই বিজয়াকে না জানিয়ে বহুদিনের প্রচলিত দুর্গাপূজা তারা বন্ধ করার ঘোষণা করে, কারণ তারা ও বিজয়া ব্রাহ্ম এবং পুতুলপূজায় অবিশ্বাসী। এতে গ্রামের সকলের হয়ে নরেন প্রতিনিধিত্ব করতে এসে বিজয়াকে এই নিষেধ প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করে। কিছুক্ষণ বিতর্কের পরে বিজয়া গ্রামের প্রজাদের কথা ভেবে নিজে দুর্গাপূজায় অবিশ্বাসী হয়েও পূজায় অনুমতি দেয়। এতে রাসবিহারীরা অসন্তুষ্ট হওয়ার সাথে সাথে বিজয়ার দৃঢ়চিত্তের প্রথম আভাস পেয়ে শঙ্কিত হয়। নরেনকে ডাক্তার হিসাবে সকলে চিনলেও সে যে জগদীশের ছেলে নরেন, তা জমিদারীতে কেউ জানত না। নদীর ধারে নরেন মাছ ধরার সময় ,সান্ধ্যভ্রমণরতা বিজয়ার হঠাত্ আলাপ হয়। প্রথম আলাপেই বিজয়া নরেনের উচ্চ গুণের পরিচয় পায়। নরেন নিজের পরিচয় গোপন রেখে নিজেকে ‘নরেনের বিশেষ বন্ধু’ হিসাবে পরিচয় দেয় এবং তার বাড়ি দেখিয়ে সে যে কী কষ্টে আছে, তা সকলই জানায়। এ ব্যাপারে বিজয়া সুবিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়। রাসবিহারী ও বিলাস এতে অসন্তুষ্ট তো হয়ই বরং সেই বাড়ির সম্পূর্ণ দখল নিয়ে সেখানে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার করে। নরেন ও বিজয়া পরস্পরের গুণমুগ্ধ হয়ে ক্রমশঃ ঘনিষ্ঠ হয়, কিন্তু তখনও পরিচয় জানতে পারে না।
এদিকে দয়ালকন্যা নলীনির সাথে নরেনের বন্ধুত্ব হয় এবং সে নরেন ও বিজয়ার পরস্পরের অনুরাগের কথা জানতে পেরে দয়ালবাবুকে সকলই জানায়। দয়ালবাবু অন্তরালে থেকে সুযোগের প্রতীক্ষা এবং বিবাহের আয়োজন করতে থাকেন। সেই সুযোগ উনি নেন বিজয়া ও বিলাসের স্থির করা বিবাহের দিনেই! সেদিন সকাল থেকে জমিদারবাড়ীতে বিজয়া ও বিলাসের বিবাহের আয়োজন। দয়ালবাবু মধ্যাহ্নে তার বাড়ীতে এক অনুষ্ঠানের নাম করে বিজয়াকে ডেকে পাঠান। সেখানে বিজয়া সবিস্ময়ে জানতে পারে, অনুষ্ঠানটি আর কিছুই নয়, তার সঙ্গে নরেনের বিবাহ! নলিনী এসে তাকে সমস্ত প্রাঞ্জল করে ও শৃঙ্গার করাতে নিয়ে যায়। অকস্মাত্ রাসবিহারী আবির্ভূত হয়ে দয়ালবাবুকে বিজয়ার স্বাক্ষরিত অঙ্গীকারপত্র দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে যে সে কিভাবে নরেনের সাথে বিজয়ার বিবাহ দিচ্ছে! এতে নলিনী বেরিয়ে এসে রাসবিহারীকে প্রতিপ্রশ্ন করে যে তিনি জগদীশবাবুকে লেখা বনমালীবাবুর চিঠি সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়েও কেন তা সম্পূর্ণ লুকিয়ে রেখে সম্পতির লোভে তার ছেলে বিলাসের সাথে বিবাহ দিতে চেয়েছিলেন এবং নরেনকে পথের ভিখারি করেছিলেন। রাসবিহারী তার সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে জেনে সেখান থেকে প্রস্থান করেন।
Goodreads Rating: 4.18/5
শরৎ সাহিত্য সমগ্র (Sarat Sahitya Samagra)
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (Sarat Chandra Chattopadhyay) সৃষ্টির বেশিরভাগটাই এই শরৎ সাহিত্য সমগ্রতে সংকলন (Sarat Chandra Chattopadhyay Novels) করা হয়েছে। কথাসাহিত্যিকের সৃ্ষ্ট বিভিন্ন উপন্যাস, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, প্রকীর্ণ এৎ অন্তর্গত। মোট দুটি খন্ড রয়েছে। এটি আপনার সংগ্রহে থাকলে আলাদা করে বিচ্ছিন্ন ভাবে পড়তে হবে না।
Goodreads Rating: 4.24/5
মহেশ (Mahesh)
মহেশ অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Sarat Chandra Chattopadhyay) রচিত একটি ছোটগল্প। কাশীনাথপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষক গফুর। তার মেয়ের সাথে সে কোনও রকমে একটি জীর্ণ ঘরে দিন গুজরান করে। তার পরিবারের সদস্য বলতে তারা দুই জন। সে আর মহেশ। সে যে গ্রামে থাকে, সে গ্রামের জমিদার শিববাবু ও তার পণ্ডিত তর্করত্ন তাকে গরুর প্রতি অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত করে। তারা গো শব্দের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা করে যবন গফুরকে বোঝালেও নিজেরা গরুকে খাওয়ার জন্য খড় দিতে অস্বীকার করে। টাকার লোভে গ্রামে গরু চরে বেড়ানোর একমাত্র মাঠ বিক্রি করে দেয়। গল্পের শেষে একটি ঘটনায় মেজাজ হারিয়ে গফুর তার মহেশকে লাঙলের ফলা দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলে, যে মহেশকে সে তার ‘ছেলে’ বলে অভিহিত করেছিল। এরপর সে গ্রামে থাকা সব কিছু ফেলে ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে চলে যায়। সে যাবার পথে উপরওয়ালার কাছে যারা মহেশের খাবার ঘাস কেড়ে নিয়েছে, খাবার পানি কেড়ে নিয়েছে, তাদের দোষ মাফ না করার অনুরোধ জানায়।
Goodreads Rating: 4.33/5
রামের সুমতি (Ramer Sumati)
রামের সুমতি বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত গল্প। গল্পটি ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয়। রামলাল গ্রামের এক দুরন্ত কিশোর। সব ব্যাপারেই তার দুষ্টু বুদ্ধির কারণে গ্রামের সবাই ভয়ে থাকে। এমনকি তার দুরন্তপনার খবর আশেপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। তার দুরন্তপনার একান্ত সহযোগী ভৃত্য ভোলা। অপরদিকে তার বৈমাত্রেয় বড় ভাই শ্যামলাল শান্ত প্রকৃতির। সে গ্রামের কাছারীতে কাজ করে ও পৈতৃক সম্পত্তি দেখাশুনা করে। তার স্ত্রী নারায়ণী যে বছর ঘরে আসে তখন রামের মা আড়াই বছরের রামকে তার হাতে দিয়ে মারা যান। সেই থেকে নারায়ণী রামকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে (Sarat Chandra Chattopadhyay Novels)। তাই রামের দুরন্তপনা ও বদমেজাজ ভৃত্য ভোলা, নৃত্যকালী এমনকি বড় ভাই শ্যামলালের উপর খাটালেও বউদিকে সে মান্য করে। বউদির জ্বর ভাল না হলে ডাক্তারকে শাসিয়ে আসে। তাদের সুখের সংসারে বিঘ্ন ঘটে নারায়ণীর মা দিগম্বরী আর ছোট বোন সুরধুনীর আগমনে। দিগম্বরী সব সময় রামের পিছনে লেগে থাকে। একদিন রাম পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা খাওয়ার সময় দিগম্বরী তাকে কটাক্ষ করলে রাম তাকে উদ্দেশ্য করে পেয়ারা ছুড়ে মারে যা নারায়ণীর মাথায় লাগে। এই ঘটনার পর শ্যামলাল দুই ভাইয়ের সম্পত্তি ভাগ করে ও নারায়ণীকে রামের সাথে কথা বলতে নিষেধ করে দেয়। আপনজন শূন্যতায় সে তার ভুলগুলো বুঝতে পারে ও তার সুমতি হয়।
Goodreads Rating: 4.14/5
দেনা পাওনা (Dena Paona)
এই উপন্যাসে শরৎচন্দ্র সেই সমাজব্যবস্থাকে চিত্রিত করেছেন যেখানে সার্বভৌম ,স্বৈরতন্ত্র তৎকালীন জমিদারী শাসনব্যবস্থা কিভাবে অবদমিত করে রেখেছিল। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর পরিচালনায় ১৯৩১ সালের ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র এটি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস (Sarat Chandra Chattopadhyay Novels) অবলম্বনে নির্মিত ও নিউ থিয়েটর্স প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রটি ভারতবর্ষের প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র হিসাবে পরিগণিত হয় (হিন্দি চলচ্চিত্র আলম আরার পাশাপাশি)। চলচ্চিত্রটিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নারীদের প্রতি অবিচার ও পণপ্রথার কদর্য রূপ দর্শিত হয়েছে। ছবিটি হিন্দিতে পূজারিন নামে পুনর্নির্মিত হয়।
Goodreads Rating: 4.07/5