সেই যে ‘অন্নপূর্ণা ও ঈশ্বরী পাটনি’র কবিতায় পড়েছিলাম ‘এ তো মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়!” মালবিকা আইয়ার (Malvika Iyer) সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এই কথাটাই মনে এল। তেরো বছর বয়সে দুটো হাত হারিয়ে ফেলেছিল মালবিকা আইয়ার (Malvika Iyer)। অসহ্য যন্ত্রণার এক অন্ধকার অধ্যায় পেরিয়ে মালবিকা (Malvika Iyer) আজ আলোর দিশারি। আজ মালবিকা (Malvika Iyer) একজন মোটিভেশনাল স্পিকার,মালবিকা র্যাম্পে শো স্টপার, মালবিকা একজন সোশ্যাল ওয়ার্কার, নারী শক্তি পুরস্কার বিজয়ী, মালবিকা একজন সুবক্তা এবং অবশ্যই মালবিকা আইয়ার (Malvika Iyer) অসংখ্য মানুষের কাছে এক অনুপ্রেরণা। মালবিকার বিষয়ে আর বেশি কিছু বলব না। আসুন আলাপ করে নিই মালবিকা ‘স্পার্ক’ আইয়ারের সঙ্গে (Malvika Iyer)।
ছোটবেলার কথা…
ছোটবেলাটা খুবই সুন্দর ছিল। আমি একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কত্থক শিল্পী। নাচ আমার রক্তে আছে। আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটের প্রতি আমার বরাবরের আকর্ষণ। আই ওয়াজ আ ক্রিয়েটিভ কিড। লোকের ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে আমি অনেক কিছু তৈরি করতাম।গান গাইতাম, নাচ করতাম, হাতের কাজ করতাম আবার স্পোর্টসেও খুব ভালো ছিলাম। আমি আসলে টমবয় ছিলাম। গাছে চড়তাম, ঘুড়ি ওড়াতাম। আমার ছোটবেলার প্রতিটা মুহূর্ত আমি উপভোগ করেছি।
হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ আর…
আমার তেরো বছর বয়স তখন।আচমকা একটা গ্রেনেড বিস্ফোরণ হল আমার হাত দুটো ছিটকে উড়ে গেল। অনেকদিন আগের কথা তাই শারীরিক যন্ত্রণাটা এখন আর অনুভব করিনা। কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা আমি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। ওটা আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছে।একটা ছটফটে মেয়ে থেকে একজন বম্ব ব্লাস্ট সারভাইভার হয়ে ওঠার এই পথটা খুবই কঠিন ছিল। কোনোদিন ভাবিনি এটা থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পারব। বাবা মার সাহায্য ছাড়া এটা হত না। বিশেষ করে আমার মা অসম্ভব সাহস জুগিয়েছেন।যখন হাসপাতালে ছিলাম টুকটাক মন্তব্য কানে আসত। সবাই বলত এই মেয়েটার কী হবে? এর তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল। ভাবতে পারছেন নিশ্চয়ই একটা তেরো বছরের মেয়ে যার দুটো হাত নেই, যে ঠিক করে হাঁটতে পারছে না, তাকে কতটা দুর্বল করে দিতে পারে এই কথাগুলো।
আলোয় ফেরা…
যে শরীর নিয়ে আমি জন্মেছি তাকে অন্যভাবে দেখা আর সেটাকে মানিয়ে নেওয়া কঠিন ছিল। আমিও নানারকম আশঙ্কায় ভুগতাম। এই ঘটনার পর প্রথম বাইরে এলাম এবং আমার বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা করলাম, তখন আমি নিজেকে লুকোবার চেষ্টা করতাম, হাত দুটো পকেটে পুরে ফেলতাম। আমি চাইতাম না কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকুক, আমায় করুণা করুক, আমায় দেখে হাসুক। তারপরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমাকে অনেক ধৈর্য ধরতে হবে। আমার যে হাত নেই এটা আমায় মেনে নিতে হবে। আলোয় ফিরতে এই ধৈর্য আর জেদই আমার সম্বল ছিল।
যা হারিয়ে গেছে…
আমি অনেক কিছু হারিয়েছি এই বিস্ফোরণে। সেগুলো আর ফিরে পাব না। যেটা হারাইনি সেটা হল আমার স্পিরিট। আমার এই ‘নেভার গিভ আপ’ স্বভাবের জন্যই আমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছি। একটা সময় ছিল সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা হত। কাটাছেঁড়া হত। তেরো বছরের একটা মেয়ে হয়ে কী করে যে সেইসব দিন পার হয়ে এসেছি আমি নিজেও জানিনা। আজ অসংখ্য মানুষ আমার কথা শুনতে চান, আমার দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। জীবনে এর থেকে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে।
নিজেকে ভালোবাসি…
আমি আমার জীবনকে খুব ভালোবাসি। আমি যা করছি সেটা ভালোবাসি। পায়ের যন্ত্রণা এখনও হয়। টেবিলের পাশে ওষুধ থাকে। কখনও কখনও খেতে হয়, বাম লাগাতে হয়। সকালে উঠে ভাবি আমার কিচ্ছু হয়নি। এই যন্ত্রণাকে আমি গ্রহণ করে নিয়েছি। আমি জানি এগুলো বলা সহজ নয় কিন্তু এটা তো আমার নতুন জন্ম। তাই এই জীবনকে আমি অবহেলা করতে পারিনা। আমাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে আবার। আর সবটাই করতে হয়েছে এই হাত দুটো ছাড়া!এটা প্রতিদিনের যুদ্ধ। কতটা কষ্ট করে যে হাত ছাড়া খেতে শিখেছি আর জামাকাপড় পরতে শিখেছি সেটা বলে বোঝাতে পারব না।
চরৈবেতি…
আমি জীবনটাকে এমনভাবেই ডিজাইন করে নিলাম যাতে সেটা শুধু আমাকে সাহস না জুগিয়ে অন্যদেরও কাজে লাগে। আমি আমার এই কাহিনি সবাইকে বলতে শুরু করলাম। দেখলাম অনেকেই আগ্রহী আমার কথা শুনতে। আর তাদেরও কিছু বলার আছে। আমি টেডএক্সে বললাম, তারপর ডাক এল রাষ্ট্রপুঞ্জ বা ইউএন থেকে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে কো-চেয়ার করলাম।একজন অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে আমার পরিচয় গড়ে উঠল। যারা শারীরিকভাবে অক্ষম তাদের প্রতি যে অন্যায় অবিচার হয়, সেটা নিয়েও প্রচার শুরু করলাম। বললাম না এটা আমার নতুন জন্ম। তাই একটা সুযোগও হাতছাড়া করতে চাইনা (হাসি)।
আমার মা…
মা খুব পজিটিভ। অতীতে ফিরে দেখায় মা বিশ্বাস করে না।মা সহজে হাল ছাড়েন না। মার আশেপাশে থাকলে আপনা থেকেই আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে।যেদিন বিস্ফোরণ ঘটেছিল সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত মা আমার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকে।বিস্ফোরণের আগের আমি আর পরের আমির মধ্যে মা কোনও তফাৎ করে না। আমরা একসঙ্গে যেমন সাফল্য উদযাপন করি সেভাবে ব্যর্থতাও মেনে নিই। মা আমাকে শিখিয়েছেন চেষ্টাটাই বড়, লক্ষ্যে পৌঁছনো নয়।যারা শারীরিক অক্ষম মানুষ আর সক্ষম মানুষদের মধ্যে কোনও তফাৎ করেন না, যারা ইকুয়ালিটিতে বিশ্বাস করেন এবং যারা সহজে হাল ছাড়েন না তারা প্রত্যেকেই অনুপ্রাণিত করেন।
সাফল্য…
অন্যদের পজিটিভভাবে অনুপ্রাণিত করাটাই আমার সবচেয়ে বড় সাফল্য। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আমায় মেল করেন, চিঠি লেখেন। আমার সঙ্গে তারা নিজেদের কাহিনি শেয়ার করে নেন। তবে হ্যাঁ, ক্লাস টেনের পরীক্ষায় আমি প্রথম হই। মাত্র তিন মাস পড়েছিলাম। আমাকে ডক্টর এপিজে আব্দুল কালাম ডেকে পাঠান। রাষ্ট্রপতি ভবনে আমার পরিবার সমেত লাল কার্পেটে আমি হেঁটে গিয়েছিলাম।অসামান্য সেই অভিজ্ঞতা। উনি আমার কথা শুনেছিলেন। তাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এমফিলে আমার থিসিস শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হয়। রোলিং কাপ পেয়েছিলাম তার জন্য। তারপর প্রথম টেডএক্সে বক্তৃতা দিলাম। নিউইয়র্কে এমারজিং লিডার পুরস্কার পাই। আর গত বছর ‘নারী শক্তি পুরস্কার’ পেলাম। জাতীয় পুরস্কার সব সময় গর্বের। আমিও গর্বিত।ইউনাইটেড নেশানে বক্তৃতা দেওয়ার পর সবাই উঠে দাঁড়িয়ে আমায় সম্মানিত করেছিলেন।সেটাও অবশ্যই মনে রাখার মতো একটা দিন।
বিশ্বাস…
আমি বিশ্বাস করি ‘ব্যাড অ্যাটিটিউড ইজ দা ওনলি ডিজেবিলিটি ইন লাইফ!’ ছোট ছোট সুখ দুঃখগুলো উপভোগ করি। পজিটিভ চিন্তায় বিশ্বাস করি।
স্বপ্ন…
আমার মতো ডিজেবল মানুষদের নিয়ে পিএইচডি করেছি। তাদের কণ্ঠ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি। আমি ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশন কনসাস।যেখানে বাঁ পাটা পুরো বাদ হতে বসেছিল সেখানে এই অ্যাকসেসেবল ফ্যাশনকে তুলে ধরার জন্য শোস্টপার হয়ে ওঠা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।আমাকে র্যাম্পে হাঁটতে দেখে অনেকেই অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, তারা শারীরিকভাবে সক্ষম হয়েও যা পারে না আমি তা করে দেখিয়েছি। সমাজের জন্যও আরও বড় কিছু করাটাই আমার স্বপ্ন।
অবসর…
বই পড়তে খু-উ-উ-ব ভালোবাসি। আমার একটি পোষ্য আছে। একটি নরওয়েজিয়ান ফরেস্ট ক্যাট। ওর নাম মিয়া। শি ইজ দা লাভ অফ মাই লাইফ! মাম্মি কি পুঁছ বলে না, ও হল তাই। সারাক্ষন আমার সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকে। ভাবছি একটা কুকুরও কিনব। বাগান করতেও ভালোবাসি। বেড়াতেও খুব ভালোবাসি।ভিনটেজ বক্স আর জাঙ্ক জুয়েলারি সংগ্রহ করা আমার নেশা।
গ্রাফিক নভেলে নবজন্ম…
আমার ডাকনাম মাই। ওই নামেই আমার জীবন নিয়ে একটা গ্রাফিক নভেল লেখা হয়েছে।ছোটদের মধ্যে বইটা খুব জনপ্রিয়।
শেষ কথা…
নারী শক্তি পুরস্কার পাওয়ার পরের দিন হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হল। মোদীজিকে একজন আমার লড়াইয়ের গল্প জানালেন। মোদীজি জানতে চাইলেন আমি প্রসথেটিক হ্যান্ড দিয়ে কাজ করিনা কেন? আমি বললাম ওটা আমি ব্যবহার করি বটে কিন্তু ওই কৃত্রিম হাত ছাড়াই আমি সব কাজ করতে পারি। মোদীজি এটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে হিন্দিতে বলেন, “অভূতপূর্ব নারী!” আই ওয়াজ এক্সাইটেড। এর চেয়ে ভালো বর্ণনা আর কি কিছু হতে পারে?
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!