আমাদের মধ্যে কেউ ডাক্তার হতে চেয়েছিল কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার। খুবই সাধারণ ইচ্ছে। সবাই কি আর রোদ্দুর হতে পারে? অমলকান্তির স্রষ্টা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (Nirendranath Chakraborty) কিন্তু রোদ্দুরের মতোই ঝলমল করতেন সর্বদা। কোনও অন্ধকার কোনও দুঃখ তার মনের মধ্যে সদা প্রবহমান আলোর ঝর্ণার স্রোতকে বদ্ধ জলায় রূপান্তরিত করতে পারেনি।অনায়াসে ঝরঝরে লেখনীতে বড়দের অন্দরমহলে বিচরণ করতেন আবার সেই একইরকম দক্ষতায় ছোটদের রঙিন বারান্দায় হেঁটে বেড়াতেন। ছোটদের পত্রিকা ‘আনন্দমেলা’ র অন্যতম দক্ষ সম্পাদক জানতেন, কচি কচি মনের দরজার আগল কীভাবে খুলে দিতে হয়। আর তাইতো অনুজ লেখকদের নিয়ে খুব সহজেই লিখিয়ে নিতে পারতেন কিছু কালজয়ী লেখা। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় স্মৃতিচারণায় অন্তত তাই বললেন। বড়দের লেখা নিয়ে মগ্ন ‘মানবজমিন’ এর স্রষ্টাকে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ র মতো কালজয়ী ছোটদের উপন্যাস লিখিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কবিতা মানেই সেখানে দাঁত ভাঙা শব্দের বাহুল্য বা এমন কিছু যা সাধারণ পাঠকদের কাছে বোধগম্য নয়, এমন কবিতা (poetry) নয়, উনি যা লিখতেন তা যেন রোজকার কথোপকথন। কখনও তিনি বলেন…
দু’ দণ্ড দাঁড়াই ঘাটে। তরঙ্গের অস্ফুট কল্লোলে /কান পাতি। যদি তার কণ্ঠের আভাস পাওয়া যায়।
যদি এই মধ্যরাতে শীত-শীত সুন্দর হাওয়ায়/নদীর গভীরে তার কান্না জেগে ওঠে। হাত রাখি
জলের শরীরে। বলি, ‘নদী, তোর নয়নের কোলে /এত অন্ধকার কেন, তুই তার অশ্রুজল নাকি?’
কবিতার নামঃ মৃত্যুর পরে
কীরকম আশ্চর্য গভীর এই কথা। মনে হয় সত্যি কোনও ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি আর পা ছুঁয়ে যাচ্ছে জলের স্রোত। আবার এই মানুষটিই টুকটুক করে ছন্দ সাজিয়েছেন। তাল দিয়ে কবি (poet) বলেছেন…
হরেক রাস্তা ঘুরতে-ঘুরতে
ভরদুপুরে পুড়তে-পুড়তে
কোথার থেকে কোথায় যাওয়া।
আকাশ থেকে জলের ঝাড়ি
হয়নি উপুড়, গুমোট ভারী,
কোত্থাও নেই কিচ্ছু হাওয়া।
এই, তোরা সব চুপ কেন রে?
আয় না হাসিঠাট্টা করে
পথের কষ্ট খানিক ভুলি।
কেউ হাসে না। ভরদুপুরে
আমরা দেখি আকাশ জুড়ে
উড়ছে সাদা পায়রাগুলি।
কবিতার নামঃ ভরদুপুরে
কে জানে হয়তো সত্যিই কোনও এক ক্লান্ত বিষণ্ণ দুপুরে এক ঝাঁক পায়রা তিনি উড়তে দেখেছিলেন। যা দেখতেন তাই তো লিখতেন। যেমন কোনও একদিন দেখেছিলেন ঘুমন্ত শিশু কোলে কোনও এক ভিখারিনী। আমরাও তো এই দৃশ্য হাজার বার দেখেছি। কিন্তু ‘কলকাতার যিশু’র মতো অমোঘ শব্দেরা ধরা দেয়না আমাদের কাছে। আর কি আশ্চর্য সমাপতন। কলকাতার যিশু চিরবিদায় নিলেন স্বয়ং যিশুর জন্মদিনে। কবির তো কখনই মৃত্যু হয়না। শুধু কালের নিয়মে জরাজীর্ণ হয় তাঁর শরীর। তিনি বেঁচে থাকেন তাঁর লেখায়। যেভাবে তিনি বার্তা দেন…
অন্ধকারের মধ্যে পরামর্শ করে
গাছগাছালি,/আজ এই রাত্রে কার ভাল আর
মন্দ কার।/ হাওয়ার ঠাণ্ডা আঙুল গিয়ে স্পর্শ করে
ঠিক যেখানে/বুকের মধ্যে নদী, নদীর বুকের মধ্যে
চোরাবালি। /স্রোতের টানে
আশিরনখ শিউরে ওঠে অন্ধকার।
(কবিতার নামঃ বুকের মধ্যে চোরাবালি)
অন্ধকার বারান্দা থেকে নেমে অমলকান্তি রোদ্দুর হয়ে গেলেন চিরকালের মতো। বলে গেলেন…
আকাশে গৈরিক আলো। হেমন্ত-দিনের মৃদু হাওয়া
কৌতুকে আঙুল রাখে ঘরের কপাটে,
জানালায়। পশ্চিমের মাঠে
মানুষের স্নিগ্ধ কণ্ঠ। কে জানে মানুষ আজও মেঘ
হতে গিয়ে স্বর্ণাভ মেঘের স্থির ছায়া
হয়ে যায় কি না। তার সমস্ত আবেগ
হয়তো সংহত হয় রোদ্দুরের হলুদ উত্তাপে।
আলো কাঁপে। সারাদিন কাঁপে।
(হলুদ আলোর কবিতা’র একটি অংশ)
আশ্চর্য রকমের জীবনীশক্তি, অফুরন্ত প্রাণ নিয়ে কবি পার হয়ে গেলেন কাঁসাই নদীর সাঁকো। জোড়া পায়ে মৃত্যুর পাঁজরে লাথি মেরে রাজার মতো চলে গেলেন।
কবির লেখা ‘অমলকান্তি’ শুনতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন
https://www.youtube.com/watch?v=ihMN4njwaIQ
কবির লেখা ‘কলকাতার যিশু’ শুনতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন
https://www.youtube.com/watch?v=-8v3L-UZsxs
কবির লেখা ‘উলঙ্গ রাজা’ শুনতে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন
https://www.youtube.com/watch?v=PS2yJsWRzzI
কবির লেখা ‘ছুটির মজা’ শুনতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন
https://www.youtube.com/watch?v=Uk0sy29n4z4
ছবি সৌজন্যঃ শ্রী চন্দন নাথ
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!