এই পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা অন্যদের মতো ভাবতে পারেন না। সমাজ তাদের দিকে আঙুল তোলে, তাদের নিয়ে হাসাহাসি করে কিন্তু তারা তাদের লক্ষ্যে অবিচল থাকেন। পূর্ণিমা দেবী বর্মণ (Purnima Devi Barman) এমনই একজন মানুষ। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (conservation) মানেই যে শুধু বাঘ বা গণ্ডার বাঁচানো নয়, তার সাথে অন্যান্য পশু পাখিদেরও সংরক্ষণের (conservation) প্রয়োজন আছে, সেটা পূর্ণিমা (Purnima Devi Barman) বুঝতে পেরেছিলেন বহু আগে। আসামের লুপ্তপ্রায় পাখি হাড়গিলা বা Greater Adjutant Stork দের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন পূর্ণিমা (Purnima Devi Barman) । তৈরি করেছেন তার ‘হাড়গিলা আর্মি।’ আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা কথা বললাম আসামের এই সবুজ (Green) যোদ্ধার সঙ্গে।
ছোটবেলার একাকীত্ব…
আমি গুয়াহাটির মেয়ে। তবে আমার জন্ম আসামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।সেই গ্রামের নাম পূবমাঝির গাঁও। সেখানেই ছোটবেলা কেটেছে।আমার বাবা আর্মিতে কাজ করতেন। বদলির চাকরি ছিল। তাই বাবা মা আমাকে ঠাকুমার কাছে থাকতে পাঠিয়ে দেন। ছ’বছর আমি ওখানে ছিলাম। ছোটবেলায় আমার খুব একা লাগত।বাবা-মাকে মিস করতাম।তবে এই একাকীত্বই আমাকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। আমি যখন বাবা মার জন্য কান্নাকাটি করতাম তখন ঠাকুমা আমাকে ধানখেতে নিয়ে যেতেন, পাখি দেখাতেন। ঠাকুমা পড়াশোনা জানতেন না, তবে পরিবেশ আর প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসতেন।আমার জীবনে আর আমার কাজে ঠাকুমার প্রভাব খুব গভীর।
জার্নি শুরু…
গুয়াহাটিতে আমি কলেজে পড়াশোনা করতে শুরু করি। স্নাতকোত্তর স্তরে আমি ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজি, ইকোলজি, জুওলজি ইত্যাদি বিষয় বেছে নিলাম। সেই সময় দুজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। একজন হলেন পরিমল চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং আর একজন হলেন প্রশান্ত সইকিয়া। এরা দুজনেই অসাধারণ মানুষ। দুজনেই ছাত্র ছাত্রীদের পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে অনুপ্রাণিত করতেন। ওঁদের হাত ধরেই আমি ‘আরণ্যক’ নামক স্বেছছাসেবী সংস্থায় যোগদান করি একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। সংরক্ষণ বিষয়টা যে আসলে কী সেটা আমি এখান থেকেই শিখতে শুরু করি।
বাবা মার সাপোর্ট…
আমি যখন স্বেচ্ছাসেবক হয়ে মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমার বাবা মা স্বপ্ন দেখছিলেন আমার উচ্চশিক্ষার। সেটাতে আমি অবশ্য কোনও দোষ দেখিনা। প্রত্যেক বাবা মারই তো ছেলে মেয়েদের নিয়ে কিছু স্বপ্ন থাকে। আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম। বাবা মা চাইতেন আমি ইউপিএসসির পরীক্ষা দিয়, গবেষণা করি। তাঁরা চাইতেন আমার জীবন সুনিশ্চিত হোক। যে সময়ের কথা বলছি তখন আসামে কেউ ভাবতেই পারত না যে একজন মহিলা পরিবেশ নিয়ে কাজ করবে।বাবা মাও জানতেন না এইসব সংরক্ষণের বিষয়ে। স্বাভাবিকভাবেই আমাকে নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ ছিল না (হাসি)। কিন্তু এখন আমার বাবা মাই আমায় সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট করেন। তারা এই হাড়গিলা আর্মির বিগেস্ট অ্যামবাসেডর।
হাড়গিলা কেন?
হাড়গিলা বা Greater Adjutant Stork লুপ্তপ্রায় পাখি।পঞ্চাশ বছর আগে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে এই পাখি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন সাড়া পৃথিবীতে মাত্র ১২০০ পাখি আছে।তার মধ্যে ৭৫% শতাংশ আসামে পাওয়া যায়। আসাম ছাড়া বিহারে আর কামবোডিয়াতে পাওয়া যায় এই হাড়গিলা। পড়াশোনা করতে করতেই জানতে পারি সংরক্ষণ বললেই লোকে বাঘ, গণ্ডার এদের কথা বোঝে। অথচ আসামে অসংখ্য প্রজাতির পশু পাখি আছে।প্রশান্ত স্যার আমায় বলেন হাড়গিলা বিষয়ে। তারা যে হারিয়ে যাচ্ছে সেটাও বলেন। আমি সেই সময় হাড়গিলা নিয়ে পিএইচডি করব বলে ভাবছিলাম।আস্তে আস্তে তথ্যও সংগ্রহ করছিলাম। ২০০৭ সালে একটা ঘটনা ঘটল। একদিন দেখলাম একটা লোক একটা গাছ কাটছে। সেই গাছে প্রচুর হাড়গিলা থাকত। আমি বোঝানোর চেষ্টা করি যে এই গাছে অনেকগুলো পাখির বাসা আছে। ওগুলোতে বাচ্চা পাখি ছিল তারা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। লোকটি তো বুঝলই না উল্টে হাসতে লাগল। ভাবল বোধ হয় আমার মাথায় কিছু গোলমাল আছে। আমার কাছে টাকা চাইল। বলল পাখিগুলো নোংরা। আশেপাশের লোকেদের ডেকে নিয়ে এল। তারাও হাসতে লাগল আমায় দেখে।
পাল্টে গেল জীবন…
ওই ঘটনা আমাকে আমূল নাড়িয়ে দিল। কোনও রকমে একটা অটো ধরে বাড়ি এলাম। সারা রাত ঘুমোতে পারলাম না। ভাবলাম একটা মানুষকেও যদি বোঝাতে না পারি, কোনও পরিবর্তন যদি না ঘটাতে পারি তাহলে পিএইচডি করে আমার কী লাভ? মনে হল পিএইচডি করে শুধু একটা ডিগ্রি পাব, তাতে এই পাখিগুলোর কিছু লাভ হবে কি? আমি সংকল্প করলাম মানুষকে বোঝাতে হবে। হাড়গিলাদের তাদের বাসা ফিরিয়ে দিতে হবে।
কিছু কি সত্যিই পাল্টেছে?
অনেকটাই পাল্টেছে। তিনটে গ্রামে ১০ হাজার মানুষ নিয়ে কাজ করতাম এখন ১৫ হাজার মানুষ আমার সঙ্গে আছেন। ওরা আমায় ‘হাড়গিলা বাইদু’ বলে ডাকে। অসমিয়াতে এর মানে হল হাড়গিলাদের বোন!২০১৭ সালে আমি ‘গ্রিন অস্কার’ পেলাম। এটাকে হুইটলি পুরস্কারও বলা হয়। রাজকুমারী অ্যান, যিনি হুইটলি ট্রাস্টের সভাপতি তিনি আমায় পুরস্কৃত করেন। এটা আমার কাছে বিরাট সম্মান। আমার রাজ্যের মানুষও আমার লড়াইটা বুঝতে পেরেছেন। এটা অনেকটা যুদ্ধ জেতার মতো। এটা আমার একার পুরস্কার নয়। এটা সবার পুরস্কার যারা আমার সঙ্গে কাজ করেন। গত বছর আমি মাননীয় রাষ্ট্রপতির হাত থেকে ‘নারী শক্তি’ পুরস্কারও পেয়েছি। সেটাও আমার কাছে এক আনন্দের মুহূর্ত ছিল।
মহিলাদের জন্য…
আমেরিকাতে রয়েছে একটি মহিলা পরিচালিত সংস্থা যাদের উদ্দ্যেশ্য হল মহিলাদের বেশি করে সংরক্ষণের কাজে যুক্ত করা। আমি এই সংস্থার ভারতীয় শাখার পরিচালক। উত্তর পূর্ব ভারতের মহিলাদের আরও বেশি করে এই কাজে যুক্ত করাটা আমার এক স্বপ্ন। অনেকেই আমায় ফোন করে বলেন, “পূর্ণিমা আপনি আমাদের অনুপ্রেরণা, আমরা আপনার পাশে আছি।” এটা আমার কাছে বিরাট প্রাপ্তি। আমার হাড়গিলা আর্মিতেও ২০০ জন মহিলা আছেন। তারা জামাকাপড়ে হাড়গিলা মোটিফ ফুটিয়ে তুলছেন, নিজেদের মতো প্রচার করছেন।
ভবিষ্যৎ…
এখনও কাজ করছি হাড়গিলাদের নিয়ে। আরও অনেকটা রাস্তা আমাদের যেতে হবে। আমি অন্যদের ট্রেনিং দিচ্ছি। এখন ওয়েটল্যান্ড বা জলাভূমি সংরক্ষণ নিয়েও কাজ করছি। আরেকটা যুদ্ধ শুরু হল আর কী (হাসতে হাসতে)!
বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ রেখামনি হাজারিকা
ছবিঃ পূর্ণিমা দেবী বর্মণ
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!