মুখবন্ধঃ
বছরের শেষ রবিবারে মৃণাল সেনকে (Mrinal Sen) শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখা লিখতে হবে ভাবতে পারিনি। ওঁর জ্ঞান, ওঁর অগাধ পড়াশোনা আর অপরিসীম অভিজ্ঞতার কাছে আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র। আমি শ্রদ্ধাঞ্জলী (Tribute, RIP) দিলাম ওঁর অগুন্তি ভক্তদের মধ্যে একজন হিসেবে। একজন সিনেমাপ্রেমী হিসেবে। যে বড় হয়েছে ‘খারিজ’ (Kharij) দেখে, ‘ভুবন সোম’, (Bhuban Some) ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘মৃগয়া’ আর ‘এক দিন অচানক’ দেখে। ভালো থাকবেন মৃণাল সেন।
ধুধু মরুভূমির উপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন উৎপল দত্ত। পরনে গুজরাতি পোশাক। অবাক হয়ে দেখছেন গ্রাম্য মেয়ে গৌরী আকা সুহাসিনী মুলেকে। গৌরীই তার জন্য নিয়ে এসেছে একটা গাছের ডাল। যার আড়ালে লুকিয়ে শিকার করবেন ভুবন সোম। আবার সেই ভুবনই গৌরীর হাতে তুলে দিচ্ছেন আহত পাখিকে। বলছেন তাকে সবাই ভয় পায়। কিন্তু পাখিরা গৌরীকে ভালোবাসে। আগের ভুবন সোম আর এখনকার ভুবন সোমের আকাশ পাতাল তফাৎ! আর সিনেমার পর্দায়(cinema) এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনকে কি অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় তুলে ধরেছিলেন মৃণাল সেন। আমাদের সবার ভালোবাসার, শ্রদ্ধার মৃণালদা। আজ সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ভবানীপুরে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন পরিচালক (Eminent Director Mrinal Sen Passed away)। বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। টুইটারে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ বচ্চন (Amitabh Bachchan) প্রমুখ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ‘ভুবন সোম’ এ তাঁর বিখ্যাত ব্যারিটোন কণ্ঠে ভয়েস ওভার দিয়েছিলেন বিগবি। মৃণাল সেন ছিলেন সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) এবং ঋত্বিক ঘটকের সমসাময়িক। কিন্তু তার পরিচালনার আঙ্গিক ছিল একদম অন্য ঘরানার, অন্য ধাঁচের। ‘ইন্টারভিউ’ তে অসামান্য অভিনয় করিয়ে নিয়েছিলেন রঞ্জিত মল্লিককে দিয়ে। ‘আকালের সন্ধানে’ মতো ছবি, তার প্রতিটি দৃশ্যায়ন, স্মিতা পাটিলের মর্মভেদী দৃষ্টি… কখনও ভোলা যায় কি?
ছবির নাম ‘নীল আকাশের নীচে’। চৈনিক বস্ত্র বিক্রেতার ভূমিকায় কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। উপহার এনেছেন মঞ্জু দের জন্য। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মঞ্জু। তিনি ঘৃণা করেন বিদেশী বস্ত্রের ব্যবহার। অথচ কালী বন্দ্যোপাধ্যায় চলে যাওয়ার পর দেখছেন তার ফেলে যাওয়া সেই উপহারের প্যাকেটের গায়ে লেখা খাদি বস্ত্র কুটির। ক্যামেরা জুম ইন হচ্ছে প্যাকেটে, জুম ইন হচ্ছে মঞ্জুর আলো আঁধারি মুখে। ভোলা যায় কি? ভুলতে পারবে কি কলকাতা? তেমনি ভুলতে পারবেনা মৃণালদাকে। কি আশ্চর্য ক্যারিশ্মা ছিল তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে। ব্যাকব্রাশ করা চুল, গভীর চোখ আর হাতে সিগারেট, সেই পরিচিত দৃশ্য আর দেখবেনা তার সাধের কলকাতা। দেশ বিদেশ মিলিয়ে বহু পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন বহুবার। মস্কো, বার্লিন এবং ভেনিসের আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে সম্মানিত হয়েছেন। সম্মানিত হয়েছেন দাদা সাহেব ফালকে পুরষ্কারে। অথচ মাটির মানুষ মৃণালদার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। সেই ঋজু ব্যক্তিত্ত্ব, সেই লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে যাওয়া।
কলকাতার সিগাল পাবলিকেশান হাউজের কর্ণধার নবীন কিশোরের কাছে ওঁর কথা শুনেছি বহুবার। তথাকথিত ‘অবাঙালি’ নবীন তখন মুগ্ধ মৃণালদার আতিথেয়তা ও মধুর ব্যবহারের পারিপাট্যে। নবীন বললেন, “আমায় তখন কেউ চিনত না। আমি মৃণালদার কাছে গেলাম। ওর লেখাগুলো নিয়ে একটা বই ছাপব বলে। মৃণালদা নিজের স্টাডিরুম আমায় উজাড় করে দিলেন।’’ ২০০২ সালে সিগাল থেকেই প্রকাশিত হয় সেনের বিখ্যাত বই ‘মন্তাজ- লাইফ, পলিটিক্স, সিনেমা।’ একইরকম গল্প শুনেছি মাধবীদির (মাধবী মুখোপাধ্যায়) কাছে। একবার এক কাজে মাধবীদিকে ফোন করেছিলাম। মাধবীদি বললেন, অভিনয় ছাড়া তাঁর এখন আরেকটা কাজ হল মৃণালদাকে দিনে একবার করে দেখতে যাওয়া। খুব দুঃখ করেছিলেন সেইদিন। বারবার বলছিলেন গীতাদি (গীতা সেন, মৃণাল সেনের স্ত্রী) চলে যাওয়ার পর ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়েছেন মৃণালদা। আর হবে নাই বা কেন? একজন কমরেডের মতো যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে পাশে পাশে ছায়ার মতো ছিলেন গীতা সেন। আজ সেই দূরত্ব ঘুচে গেল। লম্বা লম্বা পা ফেলে অনন্তের সন্ধানে পাড়ি দিলেন কলকাতার পদাতিক…
ছবি সৌজন্যঃ ফেসবুক
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!