আমরা দুজন প্রায় ৬ মাস হলো একসাথে একটা সম্পর্কে ছিলাম আর সত্যি কথা বলতে কি, আমরা একে অন্যের সাথে খুব সুখী ছিলাম. যদিও আমরা বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করিনি কিন্তু মনে মনে এটা জানতাম যে আমরা সারা জীবন একসাথে কাটাতে চাই. আমাদের এই সম্পর্ক নিয়ে আমার মা-বাবার কোনো আপত্তি ছিল না. আমার বয়ফ্রেন্ড, অর্জুন, আমার মা-বাবার সাথে দেখাও করেছিলো. আমি একদিন ক্যাসুয়ালিই ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে মা-বাবার সাথে আলাপ করিয়েছিলাম. তাতেই ওঁরা বুঝে গিয়েছিলেন.
একদিন আমি আর অর্জুন আমাদের বাড়িতে বসে টিভি দেখছিলাম আর আমরা দুজনেই খুব রোমান্টিক মুডে ছিলাম; তখনি ও বললো যে আমার ওর মা-বাবার সাথে এবার আলাপ করা উচিত.
“তোমার এবার আমার মা-বাবার সাথে আলাপ করা উচিত, ওঁরা খুব ভালো কিন্তু একটু রক্ষণশীল. তোমাকে মেনে নিতে একটু সময় লাগবে হয়তো ওঁদের.”
আমিও সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ালাম. কিন্তু মনে মনে একটু ভয়ও লাগছিলো… যদি ওঁরা আমাকে পছন্দ না করেন! আমার ছোট চুল, ছোট ঝুলের জামা-কাপড় আর রাগী স্বভাব – ওনারা নিশ্চই ওনাদের ছেলের জন্য এরকম বৌ-এর স্বপ্ন দেখেননি.
“আচ্ছা, কি পরে ওনাদের সাথে দেখা করা উচিত বোলো তো!” – আমি জিজ্ঞেস করলাম. আমার মাথায় তখন আমার ওয়ার্ডরোবে রাখা জামা-কাপড় গুলো ঘুরছে, প্রতিটা ড্রেসই ওর মা-বাবাকে ইমপ্রেস করার জন্য ফালতু মনে হচ্ছিলো. কোনটা খুব বেশি প্রিন্টেড তো কোনটা এই অকেশনের জন্য খুবই শর্ট.
“উফফ! থামো তো!” – ও বললো, “জিন্স পরে চলে এসো, ওটাই বোধয় ঠিক হবে.”
“বোধয়??” আমি আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনোরকম রিস্ক নিতে চাইছিলাম না. যেহেতু অর্জুন বুঝতে পারছিলো না, তাই পরদিনই আমি শপিং করতে গেলাম. আমি নিজেকে বদলানোর কথা ভাবছিলাম না, কিন্তু এই অকেশনের জন্য যথোপযোক্ত একটা ড্রেস খুঁজছিলাম. বেশ কয়েক ঘন্টা ঘুরেও কিছু বুঝতে পারছিলাম না যে কিরকম এথনিক ড্রেস আমার কেনা উচিত! আমার কাছে কোনো সালোয়ার-কামিজ ছিল না আর আমার মা-ই আমার জন্য জামাকাপড় কিনতেন. কিন্তু ফাইনালি একটা পারফেক্ট ড্রেস আমি খুঁজে পেলাম. ফ্যাব-ইন্ডিয়াতে একটা ফুলহাতা লাল রঙের সালোয়ার-কামিজ আমার পছন্দ হলো. ওড়না নেবার দরকার নেই এর সাথে. অবশেষে আমি রেডি অর্জুনের মা-বাবার সাথে দেখা করার জন্য, ‘বৌমা’ হিসেবে!
সেদিন যখন আমি অর্জুনের বাড়ি গেলাম ও দরজা খুলতে ওর এক্সপ্রেশন দেখেই আমি বুঝতে পারলাম যে ও আমাকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছে. মুখে বিশেষ কিছু বললো না যদিও, শুধু বললো যে ভালো লাগছে.
আমাকে ওর মা-বাবার সাথে আলাপ করলো. ওর বাবা রঞ্জন শর্মা আর মা শ্রদ্ধা শর্মাকে আমার বেশ ভালো লাগলো. আমার মা-বাবার মতো ‘কুল’ না হলেও সিনেমার রাগী মা-বাবার মতোও নন ওঁরা. আমি ভিডিও এডিটর শুনে খুব একটা খুশি হলেন বলে মনে হলো না. ঘন্টাখানেক পর ডিনার করার কথা হলো… ততক্ষন পর্যন্ত আমরা কথা-বার্তা বলতে লাগলাম.
আধঘন্টা পর অর্জুনের একটা ফোন আসতে ও কথা বলার জন্য বাইরে গেলো আর ওর মা রান্নাঘরে চা বানাতে গেলেন. আমিও রান্নাঘরে গেলাম ওনাকে বাথরুম কোথায় জিজ্ঞেস করার জন্য. উনি আমাকে ওনার সবার ঘরের বাথরুম ব্যবহার করতে বললেন.
বাথরুমে ঢোকার পর বুঝলাম আমি খুব বড় সমস্যায় পড়েছি. যেহেতু আমি সালোয়ার-কামিজ পড়তে অভ্যস্ত নই, তাই তাড়াহুড়োতে সালোয়ারের দড়ি খুলতে গিয়ে খুব টাইট গিট্ পরে গেলো. প্রায় ৫ মিনিট ধরে আমি গিট্ খোলার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ, তখন আমি অর্জুনকে মেসেজ করলাম, “তাড়াতাড়ি এসো, খুব দরকার.”
মিনিট দুয়েক পর অর্জুন সবার ঘরে আসতে আমি বাথরুমের দরজা অল্প ফাঁক করে ওকে আমার সমস্যার কথা জানালাম.
“হে ভগবান! এটা কি করেছো?” ও একটু বিরক্তি প্রকাশ করেই কথাটা বললো. ওরও দোষ ছিল না. কি জানি আমি কি ভাবতে ভাবতে দড়ি খোলার চেষ্টা করছিলাম যে খোলার বদলে বিচ্ছিরি একটা গিট্ ফেলে দিলাম আর আমার জন্য একটা বড় সমস্যা তৈরী করে ফেললাম! শেষ পর্যন্ত ও বললো যে ও নিজেই চেষ্টা করবে গিটটা খোলার. ওই মুহূর্তটা আমার জন্য খুব অদ্ভুত ছিল, আমার বয়ফ্রেন্ড আমার পাজামার দড়ি খোলার চেষ্টা করছে, কিন্তু এজন্য নয় যে ও আমার থেকে কিছু আশা করে, এইজন্য যাতে আমি টয়লেট করতে যেতে পারি! অর্জুন বাথরুমের দরজা খুলে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমার পাজামার দড়ি খোলার চেষ্টা করছিলো আর আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম. আমি এটাও ভাবছিলাম যে ও যদি আমার সাথে উল্টোপাল্টা কিছু করে! নিজের বোকামির জন্য নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিলো.
“Yes!” ও বেশ জোরে কথাটা বললো, “আমি গিট্ খুলে দিয়েছি.”
YAYY….My HERO!
আমি আনন্দে আত্মহারা হতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু হঠাৎ একটা জোরে আওয়াজ শুনলাম, “এই!”
দেখলাম অর্জুনের মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন চায়ের ট্রে হাতে আর ট্রেটা দুলছে, কারণ ওনার হাত কাঁপছিলো. ওনার শখ আমাদের দিকে ছিল, আমাদেরই দিকে… আমরা দুজনেই বাথরুমে… আমার কামিজ ওপরে ওঠানো আর ওনার ছেলে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, হাতে আমার সালোয়ারের দড়ি…
ওই মুহূর্তটা আমার জীবনের সবচেয়ে… মানে সব থেকে বাজে মুহূর্ত!
আমরা তিনজন বোধয় জমে গেছিলাম… তিনজনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম… নড়তে পারছিলাম না… আমার কান লাল হয়ে গেছিলো আর হার্টবিট এতটাই বেড়ে গেছিলো যে বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছিলো.
WHAT THE F*** আমি ঠিক বুঝতেপারছিলাম না যে এরপর কি বলবো.
ওই সিচুয়েশন থেকে অর্জুন সবার আগে বেরোলো. ও বসা অবস্থা থেকে উঠলো, নিজের চশমা ঠিক করলো আর বললো, “মা”. ওর গলায় কোনো জড়তা ছিল না, আমি ইমপ্রেস হলাম, যদিও আমার মনে হচ্ছিলো যে পৃথিবী দু’ভাগ হয়ে যাক আর আমি ঢুকে যাই তার মধ্যে…
“কি? কি হচ্ছিলো এসব?” ওর মা বললেন, ওনার চোখমুখে উদ্বেগ আর বিরক্তি স্পষ্ট.
“ঈশিকার সালোয়ারের দড়িতে গিট্ পরে গেছিলো” ও বললো; ” আমি ব্যাস ওকে হেল্প করছিলাম”. Brave, brave boy. আমি ওর কথা শুনে সত্যি ইমপ্রেস হয়ে গেছিলাম.
“কিন্তু ওর হঠাৎ সালোয়ার খোলার কি প্রজোযন হয়ে পড়েছিল?” উনি বললেন.
আমি আর থাকতে পারছিলাম না. আমি আমার সালোয়ার ধরে তাড়াতাড়ি বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম.
বাথরুম ব্যবহার করে আমি একটা স্বস্তির নিঃস্বাস নিলাম. ভালো করে চোখে মুখে জল দিলাম… আমার মুখটা এখনো লাল হয়ে ছিল, ঠিক আমার কামিজের মতো. বড় করে একটা নিঃস্বাস নিলাম, নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বাথরুম থেকে বেরোলাম.
ঘরে অর্জুন ছিল না, না ওর মা ছিলেন আর না তো চায়ের ট্রে. আমি বসার ঘরে এলাম. জানি না অর্জুন ওর মা কে কি বলেছিলো… কিন্তু উনি আমাকে ইগনোর করছিলেন. ওর বাবা আমাকে বসতে বললেন আর ফুটবল ম্যাচ দেখতে লাগলেন. আমি ওনার সাথে টুকটাক কথা বলছিলাম কিন্তু আমার পুরো মনটা অর্জুন আর ওর মায়ের দিকেই ছিল. একটু পর ডিনার সার্ভ করা হলো.
আমার খালি মনে হচ্ছিলো সময় যেন আর কাটছে না. আমি তাড়াতাড়ি খাবার খেলাম আর বাকি সবার খাওয়া শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম. খাবারটা যদিও খুব ভালো ছিল. সবার খাওয়া শেষ হতেই আমি বললাম যে আমার দেরি হচ্ছে আর আমার বাড়ি যাওয়া উচিত.
অর্জুন বললো, “আমি গাড়ি বার করছি.”
“না না, আমি ক্যাব নিয়ে নেবো.” আমি ওখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোনোর চেষ্টা করছিলাম.
“না, অর্জুন তোমাকে পৌঁছে দেবে,” ওর মা বললেন, “রাতে একা যাওয়াটা সেফ না.”
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, উনি এতো ঘটনার পরেও আমার সাথে ওনার ছেলেকে ছাড়তে রাজি হলেন.
অর্জুন গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেল. আমি আরো কিছুক্ষন দাঁড়ালাম, ওর মা-বাবাকে বায় বললাম… ওখান থেকে পালতে পারলে বাঁচি, এরকম মনে হচ্ছিলো যদিও… কিন্তু সেটা খুব খারাপ দেখাতো.. ডিনারের জন্য ওঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বেরোলাম.
ওর মা দরজা বন্ধ করার জন্য আমার সাথে এলেন. “শোনো, পরের বার কাঁচি চেয়ে নিও, আমি তোমাকে সেফটিপিনও দিতে পারতাম”
“Thanks, আন্টি..That’s very nice of you,” বলেই চলে গেলাম.
গাড়িতে বসেই আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম. “it’s okay.” ও আস্তে করে বললো. “আমি মা কে বলে দিয়েছিলাম যে কি হয়েছিল. শুনে মা তো হেসেই কুটোপাটি”. আমি ভাবছিলাম যে ওর মা নিশ্চই ভাবছেন যে ছেলে কি বোকা একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে.
“আচ্ছা শোনো,” অর্জুন বললো, “আমাদের বারান্দা থেকে এই জায়গাটা দেখা যায়, আর মা এই সময় বারান্দায় আসে”
“কি??? চলো এখন থেকে” আমি চেঁচিয়ে বললাম.
তিন বছর পর আমাদের বিয়ে হলো. এই সময়টাতে আমাদের সম্পর্কে অনেক টানাপোড়েন চলেছে. আমার মা-বাবাকে এই বিয়ের জন্য রাজি করানো খুব একটা সহজ ছিল না. আমার বাবার হঠাৎ মনে হতে লাগলো যে অর্জুন আমাকে সত্যিকরে ভালোবাসেনা. কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে গেছিলো.
ওই সালোয়ারের দড়িওয়ালা ঘটনার পর আমি ওর পরিবারের কারো সাথে খুব একটা বেশি কথাবার্তা বলিনি আর ওর মায়ের সাথে খুব ফর্মাল কিছু কথা ছাড়া আর কোনো কথা বলিনি. ও যখন ওর মা-বাবাকে বললো যে ও আমাকে বিয়ে করতে চায়, তখন ওনারা খুব খুশি হয়েছিলেন আর বিয়ের সব প্রস্তূতিও নিতে আরম্ভ করেছিলেন. জানি না ওর মা ওর বাবাকে ওই ঘটনাটা বলেছিলেন কি না, হয়তো বলেননি.
বিয়ের আগে যখন তত্ত্ব এলো, তখন বাকি জিনিস গুলির সাথে একটা খুব সুন্দর উপহার ছিল. অর্জুনের কাজিন ওই গিফটটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলো, “শ্রদ্ধা আন্টি তোমার জন্য পাঠিয়েছে.” বাক্সটা খুলতেই আমার হাত কাঁপছিলো. একটা খুব সুন্দর লাল রঙের আনারকলি ছিল বক্সটাতে, আর তার চুড়িদারে ইলাস্টিক লাগানো ছিল, দড়ি না.
আমি জানতাম যে আমি অর্জুনকে খুব ভালোবাসি, কিন্তু সেদিন থেকে ওর মাকেও ভালো না বেসে পারলাম না.