তার ঠিক আগের ভাইয়ের নাম ছিল সোম। সেই নামের সঙ্গে মিলিয়ে সদ্যোজাত শিশুর নাম রাখা হয় রবি! তখন ঠাকুরবাড়ির কেউ বোধ হয় ভাবেনওনি যে, এককালে নিজের নামের প্রতি এতটা সুবিচার করতে সক্ষম হবে সেই সদ্যোজাত শিশুটি! যদিও সুবিচারের পরিবেশ ছিল এক্কেবারে তৈরি। জন্ম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, আশপাশ ভরে রয়েছেন নামী ব্যক্তিত্বরা, ভিত তৈরি হচ্ছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-কাদম্বরী, সত্যেন্দ্রনাথ-জ্ঞানদানন্দিনীর হাতে, তিনি সাধারণ হবেনই বা কী করে! কিন্তু ধীরে-ধীরে দাদা-দিদি-বউদিদিদের কোলের ছেলেটি যে একদিন হয়ে উঠবেন সকলের মনের মানুষ, তা কি কেউ সেদিন ভাবতে পেরেছিল?
সত্যি কথা বলতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ (rabindranath) ঠাকুরবাড়ির নাকি তার বাইরের, তিনি বাংলার নাকি ভারতের, তিনি সাহিত্যিক নাকি গীতি-সুরকার নাকি শিক্ষাবিদ…এসব জটিল আলোচনা বরং অন্য কোনও আড্ডা, অন্য কোনও চায়ের কাপে তুফান তোলার জন্য তুলে রাখা যাক! তিনি আমাদের মনের বড্ড কাছের, আজও সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না-রাগ-অভিমান বোঝানোর জন্য বাঙালি মনকে বারবার তাঁর গানের আশ্রয় নিতে হয়, আজও তাঁর জন্মদিন আমরা বাংলা দিনপঞ্জী (পঁচিশে বৈশাখ হিসেবে) মেনে পালন করি, তাঁর জন্মদিনে প্রভাত ফেরি হয় না বটে, কিন্তু এফ এম রেডিও তাঁর গানই বাজায় আর পাশাপাশি দুই বাংলা এক হয়ে যায় তাঁর গানের সুরে!
রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করুন, অবশ্যই
এই ১৫৮-তম জন্মবার্ষিকীতেও (rabindra jayanti) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাসঙ্গিকতা এতটুকু হারাননি। বরং একটু অন্যরকমভাবে যদি তাঁকে দেখি, তা হলে বোঝা যাবে, আজও তিনি কতটা প্রাসঙ্গিক। তাঁর জীবনদর্শন এতটাই ভিন্ন ধর্মী যে, আগামী বেশ কয়েকটি জন্মবার্ষিকীতেও (rabindra jayanti) যদি আমরা এই একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, তা হলেও বিষয়টি পুরনো হবে না (rabindra jayanti and rabindranath)। আমরা যারা আজ ছক না মানার খেলা খেলতে ভালবাসি, তাদের আজ আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক, এক চেনা মানুষের ছক ভাঙার কথা…
গড়তে-গড়তে ভাঙেন, আবার ভাঙতে-ভাঙতে গড়েন
সমাজ চিরদিনই আমাদের চেনা কাঠামো মেনে নিজেদের গড়তে শেখায়। নতুন কোনও পথে এগিয়ে জীবনকে একটু ছক ভাঙা রাস্তায় গড়েপিটে নেওয়ার কথা আমরা প্রায় কেউই ভাবি না। কিন্তু তিনি তো রবি ঠাকুর, আর পাঁচজনের মতো চেনা ছকে জীবন সাজানো তাঁর ভাল লাগবে কেন? ভাবুন তো, আমরা সাধারণেরা ভাবি, এ আর এমন কী? সোনার চামচ মুখে করে সেই সময়ের বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম পীঠস্থানস্বরূপ বাড়িটিতে জন্মেছেন, তিনি কবিতা-উপন্যাস-গল্প লিখে নোবেল পাবেন না তো কে পাবে? অথচ, জন্মসূত্রে যিনি জমিদার, কর্মসূত্রে তিনি সাহিত্যস্রষ্ট্রা…নাঃ, এমন উদাহরণ ভূ-ভারতে আর আছে বলে তো মনে হচ্ছে না!
আর শুধু কি সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে থেমে থেকেছেন এই কর্মবীর! সবকিছু সামলে, দেশের কাজ দশের ভালর কথাও ভেবেছেন (life of rabindranath)। ঘুরে বেরিয়েছেন দেশে-বিদেশে, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন নতুন চিন্তা, নতুন ভবিষ্যতের ভাবনা, নিজের কাজের মধ্য়ে দিয়ে তা প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম তাঁর, ফলে তাঁর চিন্তাধারা ছিল সমকালীন অনেকের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। অথচ নিজের রচনার সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে কী অনায়াসে লিখে গিয়েছেন যে, “আমার কবিতা আমি জানি, যাইলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী…” কজন পারেন এমন অকপট স্বীকারোক্তি করতে (rabindranath tagore quotes)!
প্রেম ও রবীন্দ্রনাথ
“চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল, এ কথা বলিতে চাও বোলো। এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল – তার পরে যদি তুমি ভোল, মনে করাব না আমি শপথ তোমার, আসা যাওয়া দু দিকেই খোলা রবে দ্বার -যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই, আবার আসিতে হয় এসো।”
কী রোমান্টিক এই ছত্রগুলি! এমন লেখা যাঁর কলম থেকে বেরোয়, তিনিই তো প্রকৃত প্রেমিক! রবি ঠাকুর (rabindranath) ছিলেনও তাই। তিনি বারে-বারে প্রেমে পড়েছেন, সেই প্রেম কখনও তাঁকে দগ্ধ করেছে, কখনও আবার প্রেরণা জুগিয়েছে নতুন সাহিত্যসৃষ্টির। তাই বোধ হয় তিনি আমাদের তাঁর লেখার মাধ্যমে ভালবাসতেও শিখিয়েছেন। তবে রবি ঠাকুরের সাহিত্যে ভালবাসা কিন্তু বারবার ছক ভেঙেছে, হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র! বিশেষত তাঁর গল্প-উপন্যাসের নায়িকারা একেবারেই প্রেমের সনাতন পথ ধরে এগোননি। একবার ভাবুন, চোখের বালি-র বিনোদিনী নষ্টনীড়-এর চারুলতা, ঘরে-বাইরে-র বিমলা বা যোগাযোগ-এর শ্যামাসুন্দরীর কথা…সমাজের নিয়ম-নীতিকে তোয়াক্কা করে না করেই এরা এগিয়েছিল ভালবাসার আগুনে পুড়তে! এবার চরিত্রদের পাশে সরিয়ে ভাবুন স্রষ্টার কথা। একবার ভাবুন, সে সময়ের রক্ষণশীল সমাজে দাঁড়িয়ে এমনতর সাহসী প্রেমের গল্প লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, যে প্রেম কোনও নিয়ম মানে না, নিয়ম ভাঙে (life of rabindranath)! তাই তো বলি, প্রাণ দিয়ে প্রেম করুন, রবি ঠাকুরের দেখানো পথ ধরেই। আর কোনও মেঘলা দিনে যদি কারও প্রেম পড়ে যান, তা হলে এই রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করুন যে, রীতি-নীতি-সমাজ-অনুশাসনের কথা না ভেবেই তাকে মনের কথাটি জানাবেন!
রাজনীতিতে রবীন্দ্রনাথ
যে সময়ে তাঁর লেখনী ক্ষুরধার, সেই সময় দেশের জন্য বড় দুঃসময়। ভারতবর্ষ তখন ইংরেজ শাসনের শিকলে পরাধীন। একথা ঠিক যে, সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে কোনওদিন জড়িয়ে পরেননি রবীন্দ্রনাথ (rabindranath)। কিন্তু নিজেকে কখনও জনসাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নও করেননি (life of rabindranath)। তাই তাঁর কলম হয়ে উঠেছিল বিপ্লবের অস্ত্র। আর সেই বিপ্লবের ধারও কিন্তু কম ছিল না! ইংরেজ সরকার তখন দেশভক্তির সুরে গাঁথা সাহিত্য নিষিদ্ধ করে দিত এক নিমেষেই। সেসবের তোয়াক্কা না করে তিনি লিখেছেন গোরা বা ঘরে-বাইরের মতো উপন্যাস রচনা করেছেন দেশভক্তির সুরে রাঙানো একের পর এক গান। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধে আন্দলনের ইংরেজ সরকারের তীব্র বিরোধিতা করে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত গান, “বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পুণ্য় হউক, পুণ্য় হউক, পুণ্য় হউক হে ভগবান।” ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক খেতাব নাইটহু়ড ফিরিয়ে দিয়েছেন হেলায়, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ। একদিকে সুবৃহত জমিদারি, অন্যদিকে আকাশ ছোঁয়া খ্যাতি। তবু তিনি স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে মুখ সরিয়ে থাকেননি। তবে তাঁর পথ ছিল ভিন্ন, কিন্ত লক্ষ্য ছিল একই, যার প্রমাণ মেলে তার অন্য একটি লেখায়। “স্বদেশী সমাজ” প্রবন্ধে তিনি দেশগঠনের এক রূপরেখা এঁকেছিলেন। পল্লীসংগঠনের কার্যপদ্ধতি, লোকশিক্ষা এবং সমবায়ের মতো বিভিন্ন দিকের উপর আলোকপাত করেছিলেন। এমনকী, স্বাধীনতার পরে দেশের মানুষের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা, পানীয় জলের ব্যবস্থা এবং সড়ক নির্মাণের উপরও যাতে সরকার নজর দেয়, সেই নিয়েও সাওয়াল করেছিলেন।। আজও যেখানে কৃষক মৃত্যু নিয়ে সারা দেশে আগুন জ্বলছে, সেখানে বহু যুগ আগে তাঁর লেখার মাধ্যমে ঋণের দায় থেকে কৃষকদের মুক্তিদান করার আর্জি জানিয়েছিলেন কবিগুরু!
শিক্ষাবিদ নাকি শিক্ষাবিজ্ঞানী
প্রথাগত শিক্ষায় কোনওদিনই তাঁর খুব একটা ভরসা ছিল না। নিজে স্কুলে যেতে ভালবাসতেন না, আর তাই বোধ হয় নতুন এক শিক্ষা নিকেতনের ভাবনা আসে তাঁর মাথায়। সেই ভাবনারই ফসল শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী নামের কর্মযজ্ঞটি। যাঁর নিজের জীবন কেটেছে চেনা গণ্ডির বাইরে, তাঁর তৈরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও যে সব দিক থেকে অনন্য হবে, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! হয়েছিলও তাই। প্রাচীন ভারতীয় গুরুকুলের আদর্শকে তিনি নিয়ে এলেন আধুনিক জীবনের মধ্যে, বিশ্বভারতী যাত্রা শুরু করল প্রকৃতির কোলে, শিক্ষক নয়, গুরুদের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীরা খোলা আকাশের নীচেই শুরু করল এর অন্যরকম পড়াশোনা। রবীন্দ্রনাথের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ-বিদেশ থেকে কৃতীরা এসেছেন তাঁদের জ্ঞান ছাত্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে, দেশ-বিদেশ থেকে ছাত্ররাও এসেছে এই নতুন পাঠশালায় পাঠ নিতে। আর রবীন্দ্রনাথ পেয়েছেন নতুন উপাধি, হয়ে উঠেছেন সকলের মনের কাছের গুরুদেব! বিশ্বভারতীর চলার পথে নানা সময় হাজার সমস্যাও এসেছে। কখনও টাকার অভাব, তো কখনও অন্য কিছু। তবুও একদিনের জন্য থেমে যায়নি বিশ্বভারতীর বিজয়রথ। তাঁর নোবেল পুরস্কারের টাকায় শুরু হয়েছিল এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্ত্রীয়ের গয়না বিক্রির টাকাও বিশ্বভারতীর উন্নতিকল্পে নিবেদন করেছেন তিনি। আজ শিক্ষা বিজ্ঞানীরা যখন মর্ডান গুরুকুলের কনসেপ্টই সেরা বলে স্বীকার করে নিয়েছেন, তখন আমরা যেন ভুলে না যাই যে, প্রথাগত শিক্ষার চেনা ছক ভেঙে গুরুদেবই তৈরি করেছিলেন ভারতের প্রথম আদর্শ গুরুকুল!
রং-তুলি আর রবীন্দ্রনাথ
ষাট পেরনো মানে তুমি পুরনো, কাজের জায়গায় তোমার প্রয়োজন ফুরিয়ছে। এবার তোমার পালা অবসর যাপনের…এসব সত্যি হতে পারে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ঘটেছিল এর ঠিক উল্টোটাই (life of rabindranath)! তিনি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও নিজেকে অনবরত ভেঙেছেন। আরও কী-কী ভাবে নিজের ভাবনার প্রকাশ ঘটানো যায়, সেই চেষ্টায় দিনরাত ঘাম ঝরিয়েছেন। তাই তো বয়স ষাটের কোঠায় পৌঁছনোর পরেও অবসর নেননি। বরং হাতে তুলে নিয়েছিলেন রং-তুলি। কলমের পাশাপাশ তখন তুলির আঁচড়েও ফুটিয়ে তুলেছেন মনের ভাবনা, তুলির টানে রঙিন হয়ে উঠেছে একের পর এক ক্যানভাস। জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে নিজেকে এমন নতুন ভাবে আবিষ্কার করাও তো এক রকম ছক ভাঙার খেলা, তাই না!
নানা রূপে রবীন্দ্রনাথ
খেলাটা শুরু হয়েছিল তাঁর ছোটবেলাতেই। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে পরিবারের সকলে মিলে অভিনয় করতেন নিজেদেরই লেখা নাটক। ছোট্ট রবিও শুরু করেছিলেন সেভাবেই। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন তিনি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, তখনও রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে অভিনয় করেছেন নিজেরই সৃষ্টি করা চরিত্রে। বিসর্জন, ডাকঘর, বাল্মীকি প্রতিভা…একের পর এক নাটকে অভিনয় করে কবি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি কত উঁচু মানের অভিনেতা। সমকালীন আর অন্য কোনও সাহিত্যিক কিন্তু এই ছক ভাঙার সাহস করেননি!
সত্যি কথা বলতে গেলে, রবীন্দ্রনাথের পুরো জীবনটাই এক অর্থে ছক ভাঙার গল্প। লেখনী ধরা শুরু করার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও থেমে যায়নি তাঁর কলম। ভেবেছিলেন কবি হবেন, তাঁর নতুন বউঠানের প্রিয় কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর সমকক্ষ হয়ে তাঁক তাক লাগিয়ে দেবেন! কিন্তু সাহিত্যচর্চা শুরু করে দেখলেন, শুধু কবিতা রচনাতেই থেমে থাকতে পারছেন না! আস্তে-আস্তে ছড়িয়ে পড়লেন আরও বিভিন্ন দিকে। তারপর যত দিন এগিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো বাড়ির গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন বিশ্বজনীন। সামাজিক নিয়মকানুন অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চললে এই ব্যাপ্তি সম্ভব হত কি? মনে হয় না!
ছবির কৃতজ্ঞতা স্বীকার: wikipedia
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!
এগুলোও আপনি পড়তে পারেন