তাঁর ছেলে স্পেশ্যাল চাইল্ড বলে তাকে ভর্তি নেয়নি ৪২টি স্কুল! মায়ের অসহায়তা নিয়ে তিনি দেখেছিলেন, শিক্ষার অধিকারটুকু পর্যন্ত দিতে পারছেন না ছেলেকে! তাই কলকাতার শাশ্বতী সিংহ (Saswati Singh) দমে না গিয়ে তৈরি করে ফেলেছেন আস্ত একটি স্কুল। তাঁর ছেলের মতো দেশের আরও বিশেষ শিশুরা যেন শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত না হয়, তার জন্য! আজ আমরা শুনব তাঁরই লড়াইয়ের কথা!
জন্মসূত্রে শাশ্বতী কলকাতার মেয়ে। পড়াশোনা করেছেন প্র্যাট মেমোরিয়াল স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। তারপর কর্ম ও বিবাহসূত্রে তাঁকে চলে যেতে হয় রাজধানী দিল্লিতে। তাঁর ছেলের জন্মের সময় কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। শ্বাসকষ্ট হওয়ার কারণে বেশ কিছুদিন তাকে থাকতে হয়েছিল নার্সিংহোমে, নিও নেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, বিশেষ তত্ত্বাবধানে। দিনপনেরো সেখানে থাকার পর একটু সুস্থ হলে শাশ্বতী ছেলেকে নিয়ে পাড়ি দেন দিল্লি। কিন্তু দেশের মধ্যে অন্যতম দূষিত এই শহরে গিয়ে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। ফলে আবার নার্সিংহোম, আবার চিকিৎসা। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই। আবার বছরদুয়েকের মধ্যে অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয় সে, এপিলেপ্সি অ্যাটাকও হয় দু-দুবার। চলে যমে-মানুষে টানাটানি। অনেক চেষ্টার পর ছেলেকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে আসেন শাশ্বতী। কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেলেও, ওইটুকু শিশুর শরীর ও মস্তিষ্ক এত ধকল নিতে পারেনি। ফলে জন্মের সময় পুরোপুরি স্বাভাবিক ছেলেটি ধীরে-ধীরে অটিজমে (Autism) আক্রান্ত শিশুর মতো আচরণ শুরু করে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে পুরো পরিবারের!
শাশ্বতী আন্দাজ করেছিলেন ছেলের কোনও একটা সমস্যা হচ্ছে! স্কুল (school) থেকেও অমনোযোগিতার নালিশ আসতে শুরু করেছিল। শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে ছেলেকে বিশেষ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তাঁরা। পরীক্ষানিরীক্ষার পরে জানা যায়, ছেলে অটিজমে আক্রান্ত হয়েছে, যার কোনও চিকিৎসা নেই। স্কুলে কথাটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরে তাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হয় স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে! সেই শুরু, তারপর অটিস্টিক (autistic) ছেলেকে নিয়ে মোট ৪২টি স্কুলের দরজায় কড়া নেড়েছেন শাশ্বতী। কিন্তু কোনও স্কুলই তাকে শিক্ষা দিতে রাজি হয়নি!
“প্রথমে খুব কেঁদেছিলাম। ছেলেটা কি তা হলে পড়াশোনার সুযোগই পাবে না। তারপর ভাবলাম, আমি নিজেই তো পেশায় শিক্ষক! আমিই পড়াব আমার ছেলেকে!” পরে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন শাশ্বতী। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ! জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষিকা শাশ্বতী চাকরি ছেড়ে ছেলের হোম স্কুলিং শুরু করলেন। তারপর ধীরে-ধীরে তাঁর মনে হল, এমন তো অনেক শিশুই আছে, যাদের সাধারণ স্কুলে জায়গা হয় না। তাদের শিক্ষার কী হবে! আরও এগিয়ে গেলেন শাশ্বতী, খুঁজে বের করতে শুরু করলেন এই সব শিশুদের, কথা বললেন তাদের পরিবারের সঙ্গে। তারপর সকলকে নিয়ে শুরু করলেন নিজের স্কুল!
শুরুর দিনগুলো বেশ কঠিনই ছিল। ১৯৯৫ সালে দিল্লিতে শাশ্বতীর বিকাশপুরীর ফ্ল্যাটেই ছোট্ট করে শুরু হয় প্রেরণা স্পেশ্যাল স্কুলের, মাত্র ১২ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে। শাশ্বতীর অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফল আসতে শুরু করে শিগগিরই। ধীরে-ধীরে ডালপালা মেলতে শুরু করে ছোট্ট প্রেরণা। মেলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও। সেই সাহায্য আর অসংখ্য শুভানুধ্যায়ীর পরিশ্রমে প্রেরণা স্কুল এখন নব প্রেরণা ফাউন্ডেশনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রথম দিনও ছাত্রদের কাছ থেকে ১০০ টাকা নেওয়া হয় মাইনে হিসেবে, এখনও তাই নেওয়া হয়! শাশ্বতীও নিজেও পুরস্কৃত হয়েছেন বহুবার, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য। ঘুরে এসেছেন বিদেশ থেকে, সেখানকার সম্মানীয় চাকরির অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন, দেশে তাঁকে দরকার। তাঁর চারশো-রও বেশি ছেলেপুলেরা তাঁকে না দেখতে পেলে যে ভাল থাকে না!
তাঁর তৈরি সংস্থা ইনস্পিরেশন এভার ফরওয়ার্ড এখন কাজ করে দেশে স্পেশ্যাল চাইল্ডদের শিক্ষার প্রসারে, তাদের মূল স্রোতে কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, অটিজম নিয়ে লোকের মনের ভুল ধারণা কীভাবে দূর করা যায়, তা দেখতে। শাশ্বতীর স্বপ্ন কিন্তু এখানেই থেমে নেই। তাঁর ইচ্ছে, এদেশে এমন একটি গ্রাম তৈরি করার, যেখানে শুধু অটিস্টিক মানুষেরাই জায়গা পাবেন। সেই গ্রামের সবকিছু চালাবে তারাই। স্কুল-কলেজ-দোকানপাট-ব্যাঙ্ক, সবকিছু। যেদিন এই গ্রাম তৈরি করতে পারবেন শাশ্বতী, সেদিন হয়তো একটু শান্তিতে জিরোবেন!
মূল ছবি সৌজন্য: ইন্সপিরেশন দিল্লি
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!
আপনি যদি রংচঙে, মিষ্টি জিনিস কিনতে পছন্দ করেন, তা হলে POPxo Shop-এর কালেকশনে ঢুঁ মারুন। এখানে পাবেন মজার-মজার সব কফি মগ, মোবাইল কভার, কুশন, ল্যাপটপ স্লিভ ও আরও অনেক কিছু!