আপনার অঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক টুকরো ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্প, শাড়িকে এভাবে ব্যাখ্যা করলে বোধ হয় খুব একটা ভুল হবে না! যুগ পাল্টেছে, মহিলারা পাল্টেছেন, কিন্তু শাড়ি (saree) ঠিক তার নিজ মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে এখনও আমাদের আলমারি আলো করছে! আপনি বরংপরম্পরায় পেয়ে থাকুন, উপহার হিসেবেই পেয়ে থাকুন কিংবা চাকরির প্রথম মাইনে দিয়েই কিনে থাকুন, শাড়ি ব্যাপারটা বাঙালিদের কাছে এখনও বড় কাছের জিনিস। এই পোশাকটি ছাড়া আমাদের বিয়ে অসম্পূর্ণ, পুজো অসম্পূর্ণ, মায় কলেজের ফ্রেশার্স ওয়েলকামও অসম্পূর্ণ! তাই আমরা বাঙালিরা শাড়ি বড্ড ভালবাসি। আর সেই সঙ্গে ভালবাসি শাড়ির গল্প, শাড়ির ইতিহাস, বিভিন্নভাবে শাড়ি পরার কায়দা জানতেও। আজ এই শাড়িকথায় সেসব নিয়েই পাঠকদের সঙ্গে আড্ডা মারতে চলেছি আমি…
বাংলা শাড়ির ইতিহাস (History of Bengali Sarees)
এককালে কথায় বলা হত, মেয়েমানুষের বারো হাত কাপড়ে কাছা নেই! সত্যিই তো, একটি শাড়ির দৈর্ঘ্য বারো হাতের কমে হয় না। সেই শাড়ি পরার সময়ও আমরা ধুতির মতো কাছা দিই না! আসলে শাড়ি, মানে যেটি এসেছে প্রাকৃত শব্দ শাডি থেকে, যেটি আবার সংস্কৃত শাটী থেকে জন্মলাভ করেছে, সেটি তো এক খণ্ড কাপড়ের টুকরো বই আর কিছু নয়! এটি এমনভাবে জড়িয়ে পরা হত, যাতে এই কাপড়ের টুকরোও হয়ে উঠত একটি আস্ত পোশাক! এখন যদি আপনারা জিজ্ঞেস করেন যে, ঠিক কবে থেকে এই ভারতবর্ষে শাটী কিংবা শাড়ি পরার চল শুরু হল, তা হলে কিন্তু আমি বেশ একটু থতমত খাব! কারণ, এই বিষয়ে ইতিহাসমান্য কোনও তথ্যপ্রমাণাদি নেই। মানে, ওই অমুক সময়ে অমুক রাজবাড়ির রানিমা শাড়ি পরতে শুরু করলেন, আর সেই দেখে গ্রামে-গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে বলে সকলেই এই পোশাককে আপন করে নিল, এমনটা বলতে পারলে আমি ভারী খুশি হতাম ঠিকই, কিন্তু অনেক খুঁজেপেতেও তেমনটা বলার পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে পারছি কই? তবে টুকরো-টুকরো কিছু ইতিহাস আছে বটে এবং আমি তারই উপর ভর করে তিনটি যুগে এই শাড়ির ইতিহাস ভাগ করার চেষ্টা করছি। পুরো ভারতের আলোচনায় যাব না, তা হলে এই প্রতিবেদনটি ক্রমশ প্রকাশ্য আকারে প্রকাশিত করতে হবে। আপাতত বাংলার শাটীর (Bengali sarees) ইতিহাসকেই ধরে এগোই, সমগ্র ভারতের আলোচনা না হয় পরে করা যাবে।
একটু দূরের কথা, যখন শাটী-বাটি এক হয়নি!
মানে, যখন শাড়ি শুধু শাড়িই ছিল, তার সঙ্গে ব্লাউজ-পেটিকোট জুড়ে গিয়ে একেবারে জগঝম্প তৈরি হয়ে যায়নি! সেই ১৯০০ শতকের গোড়ার দিকের কথা। তখনও হিন্দু বাড়ির মেয়েরা পর্দানসীন, অন্দরমহলের চার দেওয়ালই তাঁদের জন্য খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার। তখন তাঁরা শাড়ি পরতেন ব্লাউজ-পেটিকোট ছাড়াই! শুনে অবাক লাগলেও, তা এমনভাবে পরা হত আটপৌরে ধাঁচে, যাতে লজ্জা নিবারণ তো হয়ই, উল্টে সেই শাড়ি কখনও অশালীন লাগেনি কারও চোখে। তখনকার দিনে কালীঘাটের পটচিত্রে দেখা যায় এই ধরনের শাড়ি পরে বাঙালি গৃহিণীদের ছবি। মূলত কোন ধরনের শাড়ি পরতেন তখন বাঙালি মহিলারা? পরতেন সুতির শাড়ি, পরতেন মসলিনও। কিন্তু তার বাইরে নয়।
রেনেসাঁ পরবর্তী যুগ, সাবেকি শাটী আপন করে নিল বিদেশি জ্যাকেট-পেটিকোটকে!
ঠাকুরবাড়ি, মানে যেই নামটি বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেই নামটিই আবার ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে আছে শাটীর শাড়ি হয়ে ওঠার, সর্বজনমান্য পোশাক হিসেবে আত্মপ্রকাশের সঙ্গেও। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় সন্তান, ভারতের প্রথম আইসিএস অফিসার সত্যেন্দনাথ ঠাকুরের যোগ্য সহধর্মিণী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীই একধাক্কায় সাবেকি শাটীকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক শাড়ি করে ফেলেছিলেন! কর্মসূত্রে তাঁর স্বামীকে যেতে হল বোম্বাই, সঙ্গে গেলেন তিনিও। সেখানে নিত্যদিন নানা লোকের আনাগোনা তাঁর বাড়িতে, স্বামীর কাজের সঙ্গে মানানসই করে তাঁকেও অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়, বাড়িতে সায়েব-সুবোদের সঙ্গে বসাতে হয় চায়ের আসর। আর তাঁদের সামনে সনাতনী ঢঙে খালি গায়ে শাড়ি পরে যে বেরনো যায় না, তা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি। তাই পার্সি কায়দা আর ইংরেজি ফ্যাশন, দুয়ের সমণ্বয়ে এক আলাদাই শাড়ি পরার ঢং খুঁজে বের করলেন তিনি। পার্সি কায়দায় শাড়ির আঁচল-কুঁচি দিলেন আর সঙ্গে পরে নিলেন ইংরেজি পেটিকোট (যা তখনকার ইংরেজ মহিলারা পরতেন গাউনের নীচে, শেপওয়্যার হিসেবে) এবং জ্যাকেট ব্লাউজ! ব্যস, অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়নে আত্মবিশ্বাসী জ্ঞানদানন্দিনী এগিয়ে গেলেন আর শাড়িও এগিয়ে গেল একধাপ!
এর পরও অবশ্য আরও বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা শাড়ি পরার ধরনে নিয়ে এসেছেন বৈচিত্র্য। তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে বলতেই হবে কোচবিহারের দুই মহারানির কথা। প্রথম জন ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম পুরোধা কেশব চন্দ্র সেনের মেয়ে ও কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবী, দ্বিতীয় জন তাঁরই সুযোগ্যা পুত্রবধূ ইন্দিরা দেবী। ব্রাহ্ম হয়েও কেশব সেন মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন হিন্দু পরিবারে। বিয়ের সময় নাবালিকা কন্যাকে তিনি বিদেশি ঢংয়ে সাজিয়েছিলেন বলে প্রশ্ন তুলেছিলেন কোচবিহারের পুরোহিত সম্প্রদায়। মানে, কেশব নাকি শাড়ির সঙ্গে ব্রাহ্ম কায়দায় ব্লাউজ পরিয়েছিলেন মেয়েকে আর হিন্দু শাস্ত্রমতে, বিবাহের দিন সম্প্রদানের সময় সালংকারা কন্যার গায়ে যেন সেলাই করা একটিও সুতো না থাকে! কেশব সহাস্যে রাজবাড়ির মহিলাদের বলেছিলেন, তাঁরা অন্দরে গিয়ে মেয়েকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। শাড়ি পরানোর ঢংটিই ছিল এমন, যাতে শাড়ি দিয়েই মেয়ের সারা শরীর এমনভাবে ঢাকা থাকবে যে মনে হবে মেয়ে ব্লাউজ (blouse) পরে আছে। এই মেয়ে, অর্থাৎ সুনীতি দেবী কিন্তু বিবাহের পর রাজবাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন রেনেসাঁর ছোঁয়া। তিনি শুরু করলেন পার্সি কায়দায় শাড়ি, প্লিট করা আঁচল কাঁধের কাছে আটকানো থাকত ব্রুচ দিয়ে, সঙ্গে পরতেন বিদেশি জ্যাকেট, মাথায় উপর শাড়ির আঁচলের পরিবর্তে সূক্ষ্ম লেসের কাজের ওড়না নিতেন ঘোমটা হিসেবে! তারপরে সুনীতির পুত্রবধূ ইন্দিরা দেবী এগিয়ে গেলেন আরও এক ধাপ! তিনি অল্পবয়সে বিধবা হয়েছিলেন, সাদা ভিন্ন অন্য কোনও রং পরতেন না। কিন্তু সাদা থান নয়, তাঁর অঙ্গে শোভা পেত সাহেবি কেতার তৈরি ফিনফিনে শিফনের শাড়ি, তার বুননে যেমন বৈচিত্র্য, তেমনই নতুনত্ব ছিল তার জরি বা সিল্কের পাড়েও! এঁর হাত ধরেই সারা ভারতের রাজপরিবারে শিফন শাড়ি জায়গা করে নেয়, যা এখনও বজায় আছে। কারণ, পরে তাঁরই কন্যা জয়পুরের মহারানি গায়ত্রী দেবী শিফন শাড়িকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অন্য মাত্রায়! শাড়ি পরে এককালে পোলোও খেলেছেন তিনি! তাই এখনও যখন দেখবেন, রাজপুতানার রাজওয়াড়ারা পোট্রের্টে পরে আছেন শিফন শাড়ি, জানবেন তার পিছনেও রয়েছে এক বঙ্গনারীর অবদান!
হাল আমলের শাড়িকেতা
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল পেরিয়ে শাড়ি যে আস্তে-আস্তে কবে বাইরে পা রেখেছে, তার সঠিক দিনক্ষণ বলা ভারী মুশকিল। তবে ঠাকুরবাড়ি যেহেতু ব্রাহ্ম আন্দোলনের পুরোধা ছিল আর ব্রাহ্মরা ছিলেন নবজাগরণের কাণ্ডারী, তাই এই পরিবারের মেয়েরা আধুনিক ঢংয়ে শাড়ি পরতে শুরু করেন সর্বত্র। প্রথমে ছোট্ট ঘোমটাসহ, তারপর ঘোমটা ছাড়া, আঁচল প্লিট (pleat) করার নানা কায়দা, যার কিছুটা আঁচ পাবেন এই সময় নিয়ে তৈরি বিভিন্ন বাংলা ছবিতে। তারপর দেশভাগ হল, ওপার বাংলার মেয়েরা এসে শুরু করলেন জীবনযুদ্ধ, বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আর মহিলাদের প্রধান পরিধেয় শাড়িটিও বারবার রূপ পাল্টাতে শুরু করল। বাড়ির মা-মাসিমাদের তখনও পছন্দ আটপৌরে ঢং, ক্ষেতে কাজ করার সময় মেয়েরা বেছে নিচ্ছেন গাছকোমর করে পরা শাড়ি আবার কলেজপড়ুয়া মেয়েটি ছোট হাতা ব্লাউজের সঙ্গে সরু প্লিট করে শাড়ি পরে যাচ্ছে ক্লাসে নোট নিতে সুবিধে হবে বলে!
এর পরের সময়টা আরও বিচিত্র! শাড়ি সেখানে আর পোশাক নেই, হয়ে উঠেছে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে কত কিছু। তার সঙ্গে আমরা অনায়াসে পরে নিচ্ছি শার্ট, টপ, কুর্তি ও আরও কত কিছু। কখনও ডিজাইনারের কল্পনা আশ্রয় করে সে পাড়ি দিচ্ছে বিদেশের মার্জার সরণিতে, কখনও বা দেশের মাটিতেই তাকে নতুন করে আবিষ্কার করছেন কেউ! তবে রয়েছে সে এখনও নিজ গর্বে গরবিনী হয়ে। যতই তাকে সাবেকি বলে ঠোঁট উল্টাই না কেন, অষ্টমীর অঞ্জলি কিংবা সিঁদুর খেলার সময়ে বঙ্গনারীর অঙ্গশোভা তো তাকেই হতে হয়!
বাঙালি শাড়ির ইতিবৃত্তান্ত: দেখুন তো, এই ২১টি ধরনকে কতটা ভাল করে জানতেন আপনি! ( 21 Types of Bengali Sarees)
সেই ছোটবেলায় জীবনবিজ্ঞানের কিছু চালু প্রশ্ন ছিল না, অমুক-অমুক কয় প্রকার ও কী কী, সেই ভাবে যদি আপনাকে প্রশ্ন করি, আচ্ছা, বলুন তো, বাঙালি শাড়ি কতরকমের হয়, একবারে বলতে পারবেন, নাকি হোঁচট খেতে হবে বারবার? অনেকটা কি মেমরি গেম খেলার মতো হবে, কিছুটা এগিয়ে দেখব, পুরনোটা ভুলে গিয়েছি! তাই আমরা এখানে নিয়ে এসেছি বাঙালি শাড়ির রকমফের, মানে এখনও পর্যন্ত যত রকমের শাড়ি সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে আছে, ততরকম!
১| সাধারণ তাঁতের শাড়ি (Taant Saree)
মানে, গ্রামবাংলার ঘরে-ঘরে যে শাড়ি এখনও বোনা হয় সুতির সুতো দিয়ে টানাপড়েন শৈলীতে, পুরনো কাঠের তাঁতে, তাকেই বলে তাঁতের শাড়ি। এই শাড়ি বাংলার আবহাওয়ার সঙ্গে এক্কেবারে মানানসই। এর নকশাতেও থাকে স্থানীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া। পাড়ের নকশাই বলুন কিংবা শাড়ির জমির বুটি, ফুল-পাতা-কলকা ডিজাইনের সবটাই একান্তভাবে বাংলার নিজস্ব। যদিও তাঁত শব্দটির ইংরেজি অর্থ হল হ্যান্ডলুম, অর্থাৎ, হাতে বোনা যে-কোনও শাড়িই আসলে তাঁত-এর শাড়ি, কিন্তু সাধারণ বাংলায় তাঁতের শাড়ি বলতে সারা বছর পরা যেতে পারে এমন নরম শাড়িকেই বোঝানো হয়।
২| ফুলিয়া-শান্তিপুরী (Fulia & Shantipuri Saree)
নদীয়া-নবদ্বীপের ফুলিয়ায় বাংলার তাঁতিদের মূলত বাস। তাই এখানকার তৈরি শাড়ি ফুলিয়ার শাড়ি বলে পরিচিত। কোনও আলাদা গঠনশৈলীতে এই শাড়ি তৈরি হয় না। কিন্তু এখানকার শাড়ির খ্যাতি জগৎজোড়া। কারণ, এই শাড়ি টেঁকসই ও পকেটসই। হাতে বোনা তাঁত (loom) ছাড়া ফুলিয়ায় অন্য কিছু পাওয়া যাবে না। পাওয়ারলুম (powerloom) শব্দটি এখানে এখনও অজানা! এতদিন ধরে এই গ্রামে শাড়ি বোনা হচ্ছে, এখন তাঁতিরা ন্যায্য দাম পাওয়ার জন্য সমবায় তৈরি করেছেন। ফুলিয়ায় মূলত সুতির শাড়ি বোনা হয়। বিভিন্ন ধরনের তাঁত, জামদানি, হ্যান্ডলুম শাড়ির পাশাপাশি এখন ফুলিয়ায় অনেক তাঁতির ঘরেই বিভিন্ন বড় ব্র্যান্ডের ফরমায়েশি শাড়িও বোনা হচ্ছে!
৩| ধনিয়াখালি শাড়ি (Dhaniakhali Saree)
হুগলি জেলার ধনিয়াখালি গ্রামের নামে এই শাড়ি পরিচিত হলেও, মজার ব্যাপার হল, খাস ধনিয়াখালিতে তাঁতির সংখ্যা কিন্তু হাতেগোনা! বরং ধনিয়াখালি সংলগ্ন আলা, মামুদপুর, মির্জানগর, বাসুদেবপুর, গোপীনাথপুর, বৃন্দাবনপুর ইত্যাদি গ্রামে অনেক বেশি তাঁতির বাস! কিন্তু সেই ১৮ শতক থেকে এই ধনিয়াখালি গ্রামটিই এই অঞ্চলের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হয়ে এসেছে। তাই এই গ্রামটির নামেই সমগ্র অঞ্চলের পরিচয় হয়েছে। গর্ত তাঁত ও শাটল তাঁতে এখানকার শাড়ি বোনা হয় বলে তার গঠন অন্যান্য শাড়ির তুলনায় অনেকটাই আলাদা। ধনিয়াখালি শাড়িতে আঁচল খুব সাদামাটা। সাধারণত, শাড়ির আঁচলে যে আলাদা নকশা বোনা হয়, এখানে তা করা হয় না। একইভাবে পুরো শাড়িটি বোনা হয়। এখানকার শাড়ি একটু মোটা ধরনেরও বটে। খড়খড়ে করে মাড় দেওয়া। অবশ্য প্রথমবার কাচার পর সেই মাড় অনেকটাই নেমে যায়। এখন সুতির শাড়ির পাশাপাশি এখন একরঙা তসরের শাড়িও বোনা শুরু হয়েছে।
৪| টাঙ্গাইল শাড়ি (Tangail Saree)
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার নামেই সেখানে তৈরি শাড়ির নামকরণ করা হয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ি। এই জেলায় শাড়ি তৈরির ইতিহাস বহু প্রাচীন। বলা হয়, এখানকার তাঁতিরা নাকি আসলে ঢাকাই মসলিন যাঁরা বানাতেন, তাঁদেরই বংশধর। এই এলাকার জমিদারের আমন্ত্রণে তাঁরা এখানে বসত শুরু করেন ঢাকা থেকে এসে। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যখন গাঁধীজি বিদেশি কাপড় বর্জনের ডাক দেন, তখনই টাঙ্গাইলের তাঁতিরা ইংলন্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারের সমগোত্রীয় শাড়ি এখানে বুনতে শুরু করেন! টাঙ্গাইলে এখন নানা ধরনের শাড়ি বোনা হলেও, এখানকার জামদানি ও হাফ রেশমের শাড়িই সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ।
৫| বেগমপুরী (Begumpuri Saree)
হুগলি জেলার ছোট্ট একটি শহর বেগমপুরে তৈরি হয় এই শাড়ি। বেগমপুরী শাড়ি কিন্তু অন্যান্য অনেক শাড়ির চেয়ে অনেকটাই স্বতন্ত্র। পাড়ের আকার ও পাড়ি-জমির কনট্রাস্ট রংয়ের খেলা এই শাড়িকে আলাদা করে চিনিয়ে দেবে ভিড়ের মধ্যেও। বেগমপুরী শাড়ির আরও একটু বৈশিষ্ট্য হল এর চুড়ি ডিজাইন, মানে, সারা শাড়িতে ডুরে থাকবে এবং এই ডুরেগুলির ডিজাইন ভিন্ন-ভিন্ন হবে। এখন অবশ্য নানা ধরনের মোটিফও ডিজাইন করা হচ্ছে বেগমপুরী শাড়িতে। সুতির তো বটেই, এখন লিনেন সুতোতেও তৈরি হচ্ছে বেগমপুরী মহাপাড় শাড়ি।
৬| বালুচরী ও স্বর্ণচরী (Baluchari & Swarnachari Saree)
নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ যখন গঙ্গাতীরের বালুর চরে পত্তন করেন মুর্শিদাবাদ নবাবি মহলের, তখন সেখানে তাঁর সঙ্গে বসত করতে এসেছিল তাঁর খাসমখাস সাপোর্ট স্টাফ। এদের মধ্যে ছিলেন কিছু মুষ্টিমেয় তাঁতিও। নবাব হুকুম করেন এমন এক কাপড় বানাও, যা হবে মিহি সিল্কের, কিন্তু যার নকশা দেখে তাক লেগে যাবে সকলের! নবাবের হুকুম বলে কথা! রাতারাতি তাঁতিরা তৈরি করলেন এমন এক সিল্ক, যার পাড়ে-জমিতে সুতোর নকশায় ফুটে উঠল সমকালীন নানা ঘটনা, ফুল-লতা-পাতার মোটিফ ও রামায়ণ-মহাভারতের গল্প! এই শাড়ির আঁচলে ঠাসা কাজ ও জমিতে ছোট-ছোট নকশা বা বুটি। বালুর চরে বসে এই শাড়ি বোনা হল বলে এর নামকরণ হল বালুচরী! বালুচরীতে সুতোর নকশা আর নবাবি ফরমায়েশে তৈরি করা স্বর্ণচরীতে একই নকশা ফুটে উঠল সোনা-রূপার জরিতে! কালক্রমে এই বালুর চর চলে গিয়েছে গঙ্গার গ্রাসে আর মুর্শিদকুলির সাধের বালুচরী নতুন বাসা বেঁধেছে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে!
৭| মুর্শিদাবাদ সিল্ক (Murshidabad Silk Saree)
এই শাড়ি ওই বালু চরের তৈরি সিল্কেই বোনা হয়, যা অত্যন্ত সূক্ষ্ম। খাঁটি মুর্শিদাবাদি সিল্ক অনেকটা মসলিনের মতো, আংটির মধ্যে দিয়ে না হলেও, ছোট চুড়ির মধ্য়ে দিয়ে এই শাড়ি গলে যাবেই। তবে এই শাড়িিতে কোনও নকশা করা হয়না। পরিবর্তে করা হয় নানা ধরনের ব্লক প্রিন্ট! ফলে এই শাড়ি যে-কোনও অনুষ্ঠানেই স্বচ্ছন্দে পরে ফেলা যায়।
৮| কাতান (Katan Silk Saree)
এটি মূলত বিষ্ণুপুরে তৈরি হয়। কাতান আসলে মুঘল আমলে ভারতে অণুপ্রবেশ করা একটি বুনন শিল্প। দুটি সিল্কের সুতোকে একসঙ্গে টুইস্ট করে বোনা হয় এই ধরনের ফ্যাব্রিক, যা পরে কাতান সিল্ক শাড়ি তৈরিতে কাজে আসে। বিষ্ণুপুরী কাতান টু প্লাই-থ্রি প্লাই, নানা ধরনের হয় এবং শাড়িগুলি হয় কালার ব্লক পদ্ধতিতে বোনা হয়, নয়তো তা ব্যবহার করা হয় অন্য কোনও সিল্কের শাড়ির জমি তৈরিতে। বিষ্ণুপুরী কাতান একটু খাপি মানে একটু মোটার দিকে। এটি ম্যানেজ করা একটু কঠিন, কিন্তু একবার বাগে এনে ফেলতে পারলে এই শাড়ির আভিজাত্যই আলাদা!
৯| কাঁথা (Kantha Stitch Saree)
এটি শান্তিনিকেতনের একচেটিয়া শিল্প। রান সেলাই ছোট্ট-ছোট্ট, ঠাসা ফোঁড়ে একটি শাড়িও যে শিল্প হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণ এই কাঁথাকাজের শাড়ি। গ্রামবাংলায় কাঁথা শিল্পে চল ছিল শীতকালে গায়ে দেওয়ার জন্য গরমজামা তৈরিতে! পুরনো শাড়ি পরপর বিছিয়ে, তার মধ্যে তুলোর প্রলেপ দিয়ে একসঙ্গে রান সেলাই দিয়ে তৈরি হত এই শীতবস্ত্র। এরই নাম ছিল কাঁথা। পরে এই সেলাইয়ের শৈলীই এই নামে পরিচিত হয়ে দুনিয়াজোড়া প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাই কাঁথা আসলে স্টিচ, কোনও শাড়ি বুননের কৌশল নয়! সুতি থেকে শুরু করে যে-কোনও মেটেরিয়ালের উপরেই করা হতে পারে এই স্টিচ এবং সাধারণ, একরঙা একটি শাড়ি সূঁচের সাদামাটা ফোঁড়ে হয়ে উঠবে শিল্প। একটি শাড়ি তৈরি হতে অনেকদিন সময় লাগে বলে এই শাড়ি বেশ দামি। এর নানা প্রকারভেদও আছে, পদ্মকাঁথা, রিভার্স কাঁথা, নকশিকাঁথা, ডুরে কাঁথা ইত্যাদি। প্রতিটিই স্বীয় মহিমায় উজ্জ্বল!
১০| কড়িয়াল শাড়ি (Korial Saree)
ইনি গরদেরই জাতিভাই। একই সিল্কে বোনা, জমিও একইরকম দুধসাদা বা অল্প অফ হোয়াইট, কিন্তু কড়িয়াল শাড়ির পাড় হতে পারে নানা রংয়ের। পাড়ে ও জমিতে ফুলের বা কলকার নকশা থাকবে এবং শাড়ির জমিতেও থাকতে পারে ছোট বুটি। যাঁরা গরদের সাদামাটা ধরন অতটা পছন্দ করেন না, তাঁদের জন্য আদর্শ গরদধর্মী এই কড়িয়াল শাড়ি।
১১| গরদ (Garad Saree)
দুধসাদা সিল্ক, চওড়া লাল পাড়, অল্প জরির ছোঁওয়া তাতে, আঁচলে জরি ও লালের কয়েকটা স্ট্রাইপ আর এক রাশ স্নিগ্ধতা, এভাবেই বর্ণনা করতে পারেন গরদকে! আদতে মুর্শিদাবাদে তৈরি হত এই শাড়ি এবং বোনা হত এতটাই সূক্ষ্মভাবে, যাতে শাড়িটি দেখে টিসু পেপারের কথা মনে পড়ে যেত! এই শাড়িই বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন ডিজাইন, যাকে কেন্দ্র করেই বাঙালির লাল পাড়-সাদা শাড়ির চল! আগেকার দিনে মা-ঠাকুরমারা এই শাড়ি তুলে রেখে দিতেন পুজোতে পরার জন্য। কোনও-কোনও পরিবারে তো গরদ উত্তরাধিকার সূত্রে পায় বাড়ির মেয়েরা! সেই শাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মায়ের স্নেহচ্ছায়া আর পুজোর সুবাস!
১২| জামদানি (Jamdani Saree)
যা বোনা হয় ঢাকায়, সেটিই হল ঢাকাই। অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কারিগররাই গোড়ায় এই ধরনের শাড়ি বুনতেন বলে এই নাম প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল লোকের মুখে-মুখে! কিন্তু আসলে এই শাড়ির নাম আদৌ ঢাকাই না, বরং জামদানি! জাম শব্দের অর্থ ফুল এবং দানি মানে ফুলদানি, দুয়ে মিলে জামদানি। তাই মূলত এই ধরনের শাড়িতে ফুলপাতার নকশাই দেখা যায়। পরে মোঘল অনুপ্রেরণা এবং পৃষ্ঠপোষকতায় এই শাড়ির বাহার আরও খোলে। গোড়াতে শুধুমাত্র সুতির সুতো দিয়েই এই শাড়ি বোনা হত। যত সূক্ষ্ম সুতো, তত দামি জামদানি! পরে সিল্কের সুতোও ব্যবহার করা শুরু হয়। জামদানি চার রকমের হতে পারে, ঢাকাই, ধনিয়াখালি, শান্তিপুরি ও টাঙ্গাইল।
১৩| মসলিন (Muslin Saree)
এই বিশ্ববিখ্যাত শাড়িটি সুতির সুতোয় বোনা হত, কিন্তু চমক-ঠমক এতটাই যে, দেখে বোঝার উপায় নেই তা সাদামাটা সুতির সুতোয় বোনা! ঢাকার ব্রহ্মপুত্র নদের আশপাশের অঞ্চলের তুলো দিয়েই একমাত্র তৈরি হয় মসলিনের সূক্ষ্ম সুতো এবং মুষ্টিমেয় কিছু কারিগরই তৈরি করতে পারেন এই মহার্ঘ্য শাড়ি। মসলিনেরও নানা প্রকারভেদ আছে। মলমল খাস, যেটি এতটাই সূক্ষ্ম যে একটি আংটির মধ্যে দিয়ে চলে যায় পুরো শাড়িটি, আব্রাওয়ান মসলিন, শবনম, সিরকার আলি ও টুনজেব। মসলিনে নকশা জামদানি স্টাইলেই বোনা হয়।
১৪| হ্যান্ডলুম কটন (Handloom Cotton Saree)
এটি হাল আমলের একটি আবিষ্কার। সাধারণ তাঁতে বোনা, বোনার সময় মাড় দেওয়া হয় না, শাড়িতে ডিজাইন প্রায় থাকে না বললেই চলে, শুধুই রংয়ের খেলা, হয়তো পাড়ে একটু-আধটু সুতোর কাজের খেলা, কিন্তু ওজনে হালকা এবং পরনে তুলতুলে নরম বলে আধুনিকাদের এক নম্বর পছন্দ এই শাড়ি! বাংলার গ্রামে-গ্রামে এখন এই শাড়ি বোনা হয়। এই শাড়ি বোনা এতটাই সহজ এবং তাঁতিদের জন্য কম পরিশ্রমে বেশি রোজগারের সুবিধে বলে, অনেকেই আজকাল শিল্প-টিল্প শিকেয় তুলে এই হ্যান্ডলুম কটন বোনাতে মন দিয়েছে। ফুলিয়া-শান্তিপুরে তো এই শাড়ির এখন রমরমা।
১৫| মটকা শাড়ি (Matka Silk Saree)
পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে তৈরি এক রকম খসখসে সিল্কের তৈরি শাড়িই হল মটকা। অন্যান্য সিল্কের শাড়ির সঙ্গে মটকা সিল্কের মূল তফাত হল এই শাড়ির সুতোয়। যে রেশমে এই শাড়ি বোনা হয়, সেই রেশমের সুতো তৈরির সময় তার গা থেকে আঠা তোলা হয় না। তাই মটকা সিল্ক একটু খসখসে এবং অন্য সিল্কের মতো তা অতটা নরম নয়। কিন্তু সেই কারণেই এই ধরনের শাড়ি ম্যানেজ করা অনেক সহজ এবং মেনটেন করাও সোজা। এই শাড়িতে প্রিন্ট, এমব্রয়ডারি ও সুতোর কাজ দেখতে পাওয়া যায় ট্র্যাডিশনালি। আজকাল অবশ্য নানা ধরনের ফরমায়েশি মটকাও তৈরি হচ্ছে। ব্রড মটকা, কাটশট মটকা, আড়ি মটকা ইত্যাদি হল এই ধরনের শাড়ির কয়েকটি বুননজাত প্রকারভেদ।
১৬| বাটিক প্রিন্ট (Batik Print Saree)
এটিও শান্তিনিকেতনেরই অবদান। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর কবিগুরু দেশের নানা প্রান্তের প্রায় লুপ্ত হতে বসা শিল্পকে পরম সমাদরে এখানে আবার প্রোথিত করেন! বাটিক তেমনই একটি শিল্প। কাঁথা কাজের মতো বাটিক হল আসলে শাড়ি রং করার একটি প্রক্রিয়া মাত্র, যাতে রংয়ের পাশাপাশি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল মোম! কাপড়ে (তা সে যে-কোনও প্রাকৃতিক তন্তুর তৈরি হতে পারে) প্রথমে মোম মাখিয়ে, সেই মোম মাখানো কাপড় রংয়ে চুবিয়ে, মোম ক্র্যাক করে কাপড়ে রং ঢুকে গিয়ে তৈরি হয় এই অপূর্ব ডিজাইন! পরে শাড়ি থেকে মোম তোলা ও তা শুকানো এই কাজের শেষ পর্যায়। বাটিক প্রিন্টের শাড়ি সুতিরও হতে পারে, আবার সিল্কেরও হতে পারে। আজকাল লিনেন, তসর ইত্যাদি মেটেরিয়ালের উপরেও বাটিকের কাজ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
১৭| ছাপা শাড়ি (Cotton Printed Saree)
এটি বাংলার মা-কাকিমাদের সবচেয়ে পছন্দের শাড়ি! তবে এই শাড়ি তাঁতে বোনা নয়, বোনা হয় পাওয়ারলুমে। তাই দামেও সস্তা। ছাপা শাড়ি যেমন বিভিন্ন নামীদামি ব্র্যান্ডের আছে, ঠিক তেমনই অনেক ছোট-ছোট তাঁতিরাও সমবায় প্রথায় পাওয়ারলুমে আজকাল এই শাড়ি তৈরি করেন। এই ধরনের শাড়ির আসল চমক এর ছাপা, মানে প্রিন্টে। তাই এমন নাম!
১৮| তসর (Tussar Silk Saree)
এই শাড়িটি কিন্তু গোড়া থেকে বাংলার তৈরি হত না! কিন্তু পরে কীভাবে বাঙালি রমণীর আলমারির তাকে এই ছত্তিসগড়-ঝাড়খণ্ডের শাড়িটি তার স্থান খুঁজে পেল, তা সত্যিই বিস্ময়! তসর শাড়ি পরিচিত তার খসখসে ভাব ও উজ্জ্বল সোনালি রংয়ে। আজকাল অবশ্য নানা রংয়ের ডাই করা হচ্ছে তসর শাড়িতে। পশ্চিমবঙ্গে এখনও তসরের প্রোডাকশন খুবই কম। আমরা প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে এই শাড়ি কিনে নিয়ে এসে তাতে নানা ডিজাইন করি।
১৯| লিনেন শাড়ি (Linen Saree)
ইদানীং কালের বাঙালি নারীর সবচেয়ে বেশি পছন্দের শাড়ি হল এই লিনেন। যে তুলো দিয়ে সুতির সুতো তৈরি হয়, লিনেন তৈরি হয় তার চেয়ে একটু মোটা তুলো দিয়ে আর সেই সুতোও বেশি মিহি করে কাটা হয় না। তাই লিনেন শাড়ি সুতির শাড়ির চেয়ে ভারী বেশি, এই ধরনের শাড়িতে টানাপড়েনের কাজ আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন। লিনেন শাড়িরও প্রকারভেদ আছে। আর তা হয় সুতোর মিশ্রণের উপর ভিত্তি করে। তাই পুরো লিনেন, লিনেন কটন, লিনেন সিল্ক ইত্যাদি। এখন তো তাঁতিরা লিনেনে জামদানির নকশা ফুটিয়ে তুলছেন, লিনেন করা হচ্ছে ব্লক প্রিন্ট, টাই অ্যান্ট ডাই ইত্যাদিও।
২০| প্রাকৃতিক খাদি (Khadi Saree)
খাদি শাড়ির চলন শুরু হয় ভারতে গাঁধীজির খাদি উদ্যোগ তৈরির পর থেকে। এই শাড়ি হাতে বোনা তো বটেই, শাড়ির সুতোও পুরোপুরিভাবে হাতে তৈরি, মানে, চরকায় কাটা! তাই এই শাড়ি ১০০ শতামশ খাঁটি, কোনও কৃত্রিমতার ছোঁওয়া নেই তাতে! এমনকী, খাদি রং করার জন্য ব্যবহৃত ডাইও পুরোপুরি প্রাকৃতিক রংয়ে তৈরি! সুতির খাদির পাশাপাশি খাদি সিল্কের শাড়িও যথেষ্ট জনপ্রিয়। আজকাল তাঁতিরা খাদি সুতোর সঙ্গে সুতির সুতো মিশিয়ে খাদি কটন শাড়িও তৈরি করেছেন, যা যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে।
২১| খেশ শাড়ি (Khesh Cotton Saree)
অসমের লাইসেম্বি শিল্পই বাংলায় এসে নাম নিয়েছে খেশ! টুকরো-টুকরো কাপড় মুড়িয়ে, তা জুড়ে-জুড়ে তৈরি করা হত লাইসেম্বি, যা ব্যবহার করা হত শীতবস্ত্র তৈরিতে। সেই শিল্পকেই বাঙালি তাঁতিরা নিয়ে এসেছেন শাড়ি বোনার কায়দায়। সুতির শাড়িতে লাইসেম্বি ডোরার শাড়িই হল খেশ শাড়ি। সুতিই এই শাড়ির একমাত্র ভ্যারাইটি এবং শান্তিনিকেতন অঞ্চলেই এই ধরনের শাড়ি তৈরি হয়।
শাড়ি পরার কায়দা, বাঙালি ধরন, আবার অবাঙালিও বটে! (Bengali Saree Draping Style)
এত রকম শাড়ি সম্বন্ধে তো জ্ঞান আহরণ করা গেল। এবার জানতে হবে এই শাড়িগুলি পরে কীভাবে মোহময়ী হয়ে উঠতে পারেন আপনি। সেই মা-ঠাকুরমাদের আমল থেকে আমরা নানা ধরনের শাড়ি পরার কায়দা (draping styles) রপ্ত করেছি। ব্লাউজ বিনে, ব্লাউজসহ, ব্রাহ্ম কায়দা, ঠাকুরবাড়ির কায়দা, আধুনিক কায়দা, পার্সি কায়দা ইত্য়াদি ইত্যাদি। কখনও বলিউড বাঙালি শাড়ি পরিয়েছে লেহঙ্গার স্টাইলে, কখনও আবার সত্যজিৎ-ঋতুপর্ণ আমাদের পুরনো শাড়ি পরার ঢংকে নতুন করে ভালবাসতে শিখিয়েছেন! এখানে বাঙালিদের মধ্যে জনপ্রিয় কয়েকটি শাড়ি পরার ধরন নিয়ে আলোচনা করা হল।
১| সাবেকি শাড়ি, আঁচলে চাবির গোছা (Saree Draping Style With Keyrings At The End Of The Pallu)
এই শাড়ি পরা হত ব্লাউজ-পেটিকোট ছাড়া! আপনি এখন সেটা পরতে পারবেন না। তবে পেটিকোট পরে, ব্লাউজ না পরে ট্রাই করে দেখতে পারেন। স্ট্র্যাপলেস ব্রা কিংবা টিউব টপ পরে নিন ব্লাউজের পরিবর্তে। উপর থেকে বোঝা যাবে না, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে আপনি আত্মবিশ্বাসী থাকবেন। কী করে সহজেই এই শাড়ি পরবেন, তা স্টেপ বাই স্টেপ দেখে নিন এই ভিডিয়োতে। আর হ্যাঁ, আঁচলে এক থোকা চাবি বাঁধতে ভুলবেন না যেন! ওটিই এই ধরনের শাড়ি পরার কায়দার আসল ক্যাচপয়েন্ট। উপরের ভিডিয়োতে প্লিট ছাড়া আটপৌরে কায়দায় শাড়ি পরার স্টাইল দেখানো হয়েছে।
২| আটপৌরে ধরন (Atpoure Style)
এই ধরনের শাড়ি অনেকটা সাবেকি ধাঁচেই পরা হয়, শুধু পার্থক্য হল এটির সঙ্গে সেমিজ পরতেন ঠাকুরমারা আর আমরা পরি ব্লাউজ! প্রসঙ্গত, এই ধরনের শাড়িই বলিউডের সব ছবিতে খাঁটি বাঙালি ধরন বলে দেখানো হয়ে থাকে! কীভাবে এই শাড়ি পরবেন, তা দেখে নিন উপরের ভিডিয়োতে। প্রসঙ্গত, এই ধরনের শাড়ি ড্রেপিং স্টাইলে আঁচলে চার-পাঁচটির বেশি প্লিট করবেন না। আর আঁচল নিতে পারেন তিন রকম ভাবে। মোটা আঁচল ও সরু আঁচল একসঙ্গে, মোটা ও সরু বিপরীত কাঁধে এবং মোটা ও সরু একসঙ্গে প্লিট করে। তবে শিফন বা জর্জেট শাড়ি এভাবে পরতে যাবেন না বলিউডি কায়দায়, বেষ খারাপ লাগে দেখতে!
৩| ব্রাহ্মসমাজি কায়দায় আধুনিকতার ছোঁওয়া (Brahmo Shamaji Style)
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম না, কেশব সেন আর তাঁর মেয়ে সুনীতি দেবীর কথা! তাঁরা যেভাবে শাড়ি পরা শুরু করেছিলেন, এটা অনেকটা সেরকম। তবে এখন এটি অনেক আধুনিকাও পরে থাকেন। এক্ষেত্রে শাড়ির সঙ্গে জ্যাকেট পরার সময় জ্যাকেটের উপর দিয়ে কিংবা ভিতর দিয়েও শাড়ির আঁচল দেওয়া হয়। উপরের ভিডিয়োতে সেই পুরনো কায়দাকেই এখনকার মতো সাজিয়েগুছিয়ে সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছে।
৪| ঠাকুরবাড়ি স্টাইলের বর্তমান সংস্করণ (Thakurbari Style)
ঠাকুরবাড়ির শাড়ি পরার ধারাটিই এখন আমরা রপ্ত করে ফেলেছি একটু এদিকওদিক করে। এঁরা আঁচল দিতেন বড় করে এবং আঁচল প্লিট করে তাতে ব্রুচও লাগাতেন। উপরের ভিডিয়োতে তিন ধরনের স্টাইল দেখানো হয়েছে। এই স্টাইলে আপনি আঁচল বড় রেখে শাড়ি পরতে পারবেন। যদি আরও সাবেকি ধাঁচে যেতে চান, তা হলে পরুন তখনকার দিনের মতো একটু লম্বা কুর্তা ব্লাউজ, হাতায় কুঁচি দেওয়া ব্লাউজ অথবা জ্যাকেট।
৫| এখন যেমন চলে (Modern Style Saree Draping)
এখনকার দিকে সরু প্লিট করে আঁচল এবং ছোট প্লিটের কুঁচি, শাড়ি পরার এই স্টাইলটাই বেশি চলে। এই ধরনের শাড়ি পরা বেশ সোজা, কিছু নিয়ম মাথায় রাখলে। উপরের ভিডিয়োতে সেই নিয়মগুলিই সুন্দর করে বোঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে শাড়ি প্রথমে গোঁজার সময় একটা গিঁট বেঁধে গুঁজবেন যাতে শাড়ির প্রথম ভাগটি পায়ের তলায় বেরিয়ে এসে বারবার সমস্যা তৈরি না করে। পেটিকোট পরবেন নাভি থেকে নীচে রেখে, নইলে মোটা দেখতে লাগবে। কুঁচি গুঁজবেন একদম মাঝখানে এবং যেখানে-যেখানে প্রয়োজন, অতি অবশ্যই সেফটিপিন ব্যবহার করবেন।
৬| একেই বলে ফিউশন (Fusion Style Saree)
টিনএজাররা, যারা শাড়ি পরতে একেবারেই ভালবাসে না এবং শাড়ি মানেই যাদের কাছে মা-ঠাকুরমাদের পোশাক, যা ক্যারি করাটা ঝকমারি ও পরতে যাওয়া মানে সময় নষ্ট, তারা এই ধরনের ফিউশন স্টাইল ট্রাই করতে পারে। অবশ্য শুধু তারা কেন, আমি-আপনিই বা বাদ যাই কেন বলুন তো! এই ধরন করে শাড়ি পরা সহজ, ক্যারি করা সোজা এবং কেতা করা যায় অনায়াসে! উপরের ভিডিয়ো দেখে চটপট প্র্যাকটিস করে ফেলুন ফিউশন স্টাইলে শাড়ি পরার কায়দা!
৭| পার্সি কেতা (Parsi Style Saree Draping)
এই কায়দাতেই জ্ঞানদানন্দিনী দেবী প্রথম শাড়ি পরতে শুরু করেছিলেন যা পরে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল সমাজের উঁচু স্তরের আলোকপ্রাপ্তা মহিলাদের মধ্যে। এই ধাঁচে এখনও অনেক ফ্যাশন ডিজাইনাররাই তাঁদের শাড়ি ড্রেপ করান। এই কায়দায় শাড়ি পরা খুবই সহজ এবং ক্যারি করাও খুব সোজা। তা ছাড়া আপনি বিভিন্ন ধরনের ব্লাউজের সঙ্গে এই কায়দায় শাড়ি পরতে পারবেন। উপরের ভিডিয়োটিতে খুব সহজ করে পার্সি কায়দায় শাড়ি পরানো দেখানো হয়েছে।
শাড়ি নিয়ে কিছু টিপস, যা আপনাকে করে তুলবে আল্টিমেট শাড়ি কুইন (How To Wear Saree: Tips & Tricks)
শাড়ি পরার যেমন নানা কায়দা আছে, শাড়ির নানা ধরন আছে, তেমনই এর সঙ্গে জড়িত আছে কিছু লুকনো ম্যাজিকও! সেই ম্যাজিকের ঝাঁপিই খুলেছি আমরা এখানে…
- সেফটিপিন হল শাড়ি পরার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যখনই একটু অস্বস্তি হবে আঁচল কিংবা কুঁচি নিয়ে, সত্বর সেফটিপিন ব্যবহার করুন। এতে শাড়ি এবং আপনি, দুজনেই শান্তিতে থাকবেন!
- আঁচল প্লিট করতে অসুবিধে হলে শাড়ি পরার আগেই তা বিছানায় ছড়িয়ে আঁচল প্লিট করে সেফটিপিন লাগিয়ে তারপর পরুন। এতে সময়ও বাঁচবে, মেহনতও!
- শাড়ির সঙ্গে পেটিকোট বাছুন মন দিয়ে। আজকাল নানারকমের শেপওয়্যার পাওয়া যায়। পেটিকোটের পরিবর্তে সেগুলোও ট্রাই করে দেখতে পারেন।
- শাড়ি আলমারিতে রাখার সময় তার ভাঁজে-ভাঁজে ধূপের খালি প্যাকেট গুঁজে রাখুন। এতে খুব সুন্দর মিষ্টি গন্ধ হয়ে থাকবে শাড়িতে।
- সুতির শাড়িতে মাড় দেওয়াটা বেশ ঝকমারি ব্যাপার। বাজারের রেডিমেড মাড় ছাড়াও বাড়িতে ময়দার মাড় দিতে পারেন।
- সুতির শাড়ি একবার পরে নিলে সেটি যত্ন করে ভাঁজ করে খাটের গদির নীচে রেখে দিন। ভাঁজে-ভাঁজে সুন্দর স্বাভাবিক ইস্ত্রি হয়ে যাবে।
- এমন কয়েকটি ব্লাউজ আপনার সংগ্রহে রাখুন, যা সব শাড়ির সঙ্গে হয় ম্যাচিং নয় কনট্রাস্ট!
শাড়ি একবার পরা হয়ে গেলে, পরের বার পরার সময় আগের বারের কুঁচির দাগের সঙ্গে মিলিয়ে কুঁচি দেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে পরতে সুবিধে হবে। শাড়ির ফলও ভাল হবে। - সিল্ক বা শিফনের শাড়িতে অতি অবশ্যই কুঁচিতে সেফটিপিন লাগিয়ে নেবেন। তবে শাড়িতে ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে তৈরি মোটা, বড় সেফটিপিন।
- শাড়িতে কোনও সময় পারফিউম স্প্রে করবেন না। এতে দাগ পড়ে যায়, যা পরে তোলা সম্ভব হয় না।
- কোনও অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে গেলে যদি কোনও খাবারের দাগ লেগে যায়, তা হলে বাড়িতে এসে শাড়িটি যত শিগগিরই সম্ভব ড্রাই ক্লিনিংয়ে পাঠান। দোকানে দাগ লাগার জায়গাটা দেখিয়ে দিতেও ভুলবেন না। আর নিজে দাগ তোলার চেষ্টা করবেন না।
- যে আলমারিতে আপনি শাড়ি রাখেন, মাঝে-মাঝে, বিশেষত বর্ষাকালে তা পরিষ্কার করে নতুন সিলিকা জেল অথবা কাগজে মুড়ে ন্যাপথালিন বল রেখে দিন সেখানে। এতে শাড়ি ভাল থাকবে।
শাড়ি নিয়ে কিছু প্রশ্নোত্তর, যা আপনাদের সাহায্য করবে (FAQs)
১। শাড়ি ড্রেপিংয়ের সময় কী ছোট সেফটিপিন ব্যবহার করা উচিত, যাতে না চোখে পড়ে?
উত্তর: একেবারেই না! বরং শাড়ির জন্য বিশেষভাবে তৈরি বড় সেফটিপিন ব্যবহার করুন। তা এমনভাবে লাগান, যাতে চোখে না পড়ে। কিন্তু ছোট সেফটিপিন লাগালে শাড়ি খোলার সময় তা বেঁকে গিয়ে শাড়ির মধ্যে ঢুকে যেতে পারে, যা কোনওভাবেই কাম্য নয়!
২। সিল্কের শাড়ি কি বাড়িতে কাচা যেতে পারে, নাকি লন্ড্রিতে কাচতে দেওয়া উচিত?
উত্তর: সিল্কের শাড়ি বাড়িতে না কাচাটাই ভাল। যদি নিতান্তই কাচতে চান, তা হলে প্লেন প্রিন্টেড সিল্ক কাচতে পারেন। ভারী সিল্ক একেবারেই নয়। প্লেন প্রিন্টেড সিল্ক কাচতে ব্যবহার করুন ইজি কিংবা জেন্টিলের মতো উলের কাপড় কাচার মাইল্ড ডিটারজেন্ট। একটুক্ষণ এই সাবানে শাড়ি ভিজিয়ে রেখে তুলে ঠান্ডা জলে ধুয়ে ফেলুন। তারপর জল ঝরতে দিয়ে মেলে দিন। একেবারেই নিংড়োবেন না কিন্তু!
৩। শাড়ি আলমারিতে ভাঁজ করে রাখা উচিত, নাকি ঝুলিয়ে?
উত্তর: অতি অবশ্যই ভাঁজ করে। নিয়মিত শাড়ি না পরা হলে কিছুদিন পরপর শাড়ি বের করে আবার উল্টো ভাঁজে ভাঁজ করে রাখুন। এতে শাড়ি ভাল থাকবে। শিফন কিংবা জর্জেটের শাড়ি অবশ্য ঝুলিয়ে রাখতে পারেন।
৪। ন্যাচারাল ডাইয়ের শাড়ি কি প্রথমবার পরার আগে নুন জলে ভিজিয়ে রাখা উচিত যাতে রং পাকা হয়ে যায়?
উত্তর: না। তাতে রং পাকা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শাড়ির সুতো খারাপ হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। তা ছাড়া ন্যাচারাল ডাই রং ছাড়বেই, তা আপনি যতই নুন জলে ভিজিয়ে রাখুন না কেন!
৫। শাড়ি খুলে ফেলার কতক্ষণ পরে আলমারিতে তোলা উচিত?
উত্তর: যদি সারাদিন কোনও শাড়ি পরে থাকেন, তা হলে তা বড় ভাঁজ করে অন্তত ঘণ্টাখানেক খোলা হাওয়ায় মেলে রাখুন। শাড়িতে লাগা ঘাম তাতে ভাল করে শুকিয়ে যাবে। তারপরই তা আলমারিতে তুলবেন।
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!
আপনি যদি রংচঙে, মিষ্টি জিনিস কিনতে পছন্দ করেন, তা হলে POPxo Shop-এর কালেকশনে ঢুঁ মারুন। এখানে পাবেন মজার-মজার সব কফি মগ, মোবাইল কভার, কুশন, ল্যাপটপ স্লিভ ও আরও অনেক কিছু!