মেনোপজ( Menopause) নিয়ে আমাদের মনে নানা ধারণা আছে। তার মধ্যে কিছু ভুল আর কিছু ঠিক। অনেক মহিলাই এই নিয়ে নানা দুশ্চিন্তায় ভোগেন। অনেকে আবার ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এর ফলে অনেক সময়ই শরীরের সাথে সাথে নানা মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়।তাই প্রথমেই বলে রাখি মেনোপজ কিন্তু কোনও অসুখ নয়। প্রকৃতির নিয়মে আপনি ঋতুমতী হয়ে থাকেন আবার প্রকৃতির নিয়মেই সেই ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। এতে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ার কোনও কারণ নেই। মেনোপজ নিয়ে আমরা যেমন কিছু কিছু জানি, ঠিক সেরকমই অনেক কিছু জানি না। তাই আপনাদের জন্য রইল কিছু জরুরি তথ্য। এর পরে যদি কেউ আপনাকে প্রশ্ন করে মেনোপজ বিষয়ে আপনি কী জানেন? তাহলে তাকে গুছিয়ে সুন্দর করে উত্তর দিতে আপনি নিশ্চয়ই পারবেন।
আরো পড়ুনঃ সাদাস্রাবের কারণ ও সমাধান
মেনোপজ কী? (What is menopause)
যখন একটানা বারো মাস আপনার ঋতুস্রাব হয় না এবং আপনি আর স্বাভাবিক ভাবে গর্ভবতী হতে পারেন না, বুঝতে হবে আপনার মেনোপজ শুরু হয়ে গেছে। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী মহিলাদের মেনোপজ হয়। তবে শারীরিক গঠনের উপর নির্ভর করে অনেক মহিলারই এই বয়সসীমার আগে ও পরে মেনোপজ হয়ে থাকে।মেনোপজ শুরু হওয়ার আগে কিছু অস্বস্তিকর লক্ষণ (symptoms) দেখা যায়। যেমন হট ফ্লাশ বা আচমকা ওজন বৃদ্ধি ইত্যাদি। অনেক মহিলারা এতে ভয় পেয়ে ডাক্তারের কাছে যান। তবে এগুলো মেনোপজের সঙ্গে সম্পর্কিত খুবই সাধারণ ঘটনা। তাই এগুলো শুরু হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
এই সময় চাই পরিবারের সাহচর্য
মেনোপজ কখন শুরু হয় এবং কতদিন স্থায়ী হয়? (when does menopause start and how long does it last?)
সাধারণত মহিলাদের শেষ বার পিরিয়ড হওয়ার চার বছর আগে মেনোপজের লক্ষণ দেখা যায়। অনেক সময় চার বছর ধরেই এবং শেষ পিরিয়ড হওয়া পর্যন্ত এই লক্ষণগুলো চলতে থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো বছর বারো আগে থেকেই দেখা যায়। তবে এই ঘটনা ১০ জনের মধ্যে ১ জন মহিলার ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। বেশিরভাগ মহিলার মেনোপজ শুরু হয় ৫১ বছর বয়সে। তবে দেশ, শারীরিক গঠন ভেদে মহিলাদের মেনোপজ শুরু হওয়ার সময় আলাদা হয়।
কখন আপনার মেনোপজ শুরু হবে সেটা মূলত নির্ভর করে আপনার জেনেটিক গঠন ও ওভারির (ovary) স্বাস্থ্যের উপর। মেনোপজের আগে অনেক সময় শুরু হয় পেরিমেনোপজ। পেরিমেনোপজ হওয়ার অর্থ হল যখন আপনার শরীর থেকে নিঃসৃত হরমোন আপনাকে মেনোপজের জন্য তৈরি করে তুলছে। এই পেরিমেনোপজ কখনও এক মাস আবার কখনও কয়েক বছর স্থায়ী হয়। কিছু মহিলারা মধ্য চল্লিশে এসে পেরিমেনোপজের (perimenopause) মুখোমুখি হন। অনেকে আবার এই স্টেজ পার করে সরাসরি মেনোপজের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। সারা পৃথিবীতে ১ শতাংশ মহিলার মেনোপজ শুরু হয় ৪০ এর আগে। আর ৫% মহিলার মেনোপজ শুরু হয় ৪০ থেকে ৪৫ এর মধ্যে। একে বলে প্রিম্যাচিওর মেনোপজ (premature menopause) বা প্রাইমারি ওভারিয়ান ইনসাফিসিয়েন্সি (primary ovarian insufficiency)।
পেরিমেনোপজ, মেনোপজ ও পোস্টমেনোপজ (Perimenopasue, Menopause, postmenopause)
পেরিমেনোপজ হওয়ার পর মাসিক ঋতুস্রাব অনিয়মিত হতে শুরু করে। দেখা যায় আপনার তারিখের হিসেব আগে পরে হয়ে যাচ্ছে। প্রতিমাসেই এরকম হচ্ছে। বা কোনও কোনও মাসে আপনার ঋতুস্রাব হচ্ছেই না। রক্তের ফ্লো অনেক সময় ঘন আবার কখনও পাতলা হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায় মহিলারা এই তিনটে শব্দ নিয়ে খুব কনফিউশান থাকে। এই তিনটে শব্দের অর্থ পরিষ্কার হওয়া দরকার।
মেনোপজ হল যখন দীর্ঘ এক বছর ধরে আপনার মাসিক ঋতুস্রাব হচ্ছে না। মেনোপজ শুরু হওয়ার আগে থেকে যে লক্ষণগুলো আপনার শরীরে দেখা যায় সেটা হল পেরিমেনোপজ দশা। আর মেনোপজ হওয়ার এক বছর পরে হয় পোস্টমেনোপজ দশা।
মেনোপজের লক্ষণগুলো কী কী? (symptoms of Menopause)
মেনোপজের লক্ষণ চুল পড়া
একেক জন মহিলার ক্ষেত্রে মেনোপজের লক্ষণ একেক রকম হয়। যখন মেনোপজ হঠাৎ করে শুরু হয়ে যায় তখন এই লক্ষণগুলো আরও বেশি করে প্রকট হয়। ওভারির স্বাস্থ্যের সঙ্গে যে অসুখগুলো জড়িত যেমন ক্যানসার, হিসটিরেকটোমি বা জীবনযাত্রার কিছু অঙ্গ যেমন ধূমপান ইত্যাদি মেনোপজের লক্ষণগুলো অনেক তাড়াতাড়ি আমাদের জীবনে নিয়ে আসে। মেনোপজ ছাড়াও পেরিমেনোপজ ও পোস্টমেনোপজের লক্ষণগুলোও মোটামুটি একই রকমের।
পেরিমেনোপজের লক্ষণ হল
ঋতুস্রাবের ফ্লো (menstrural flow) কমে যাওয়া
এর আগে আপনার যেরকম স্বাভাবিক ঋতুস্রাব হত, তার চেয়ে বেশি বা কম ঋতুস্রাব হওয়া।
ভাসোমোটোর সিম্পটম (vasomotor symptoms) যেমন হট ফ্লাশ (hot flush), নাইট সোয়েট (night sweat) ও ফ্লাশ (flush)। গবেষণা বলছে ৭৫% মহিলার মেনোপজের সময় ভাসোমোটোর সিম্পটম হয়ে থাকে।
এছাড়া মেনোপজের অন্যান্য লক্ষণগুলি হল
অনিদ্রা (Insomnia)
ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস (vaginal dryness)
ওজন বৃদ্ধি (weight gain)
অবসাদ (depression)
অস্থিরতা (anxiety)
মনোযোগ কমে যাওয়া (lack of concentration)
স্মৃতি দুর্বল হয়ে যাওয়া (loss of memory)
যৌন মিলনের আকাঙ্খা কমে যাওয়া (reduced libido or sex drive)
ত্বক, মুখ ও চোখে শুষ্কতা (dry mouth, eye and skin)
অনেকবার মূত্রত্যাগ (frequent urination)
স্তন নরম হয়ে যাওয়া (sore or tender breast)
মাথা ধরা (headache)
দ্রুত হৃদস্পন্দন (fast heartbeat)
মূত্রনালীতে সংক্রমণ (Urinary tract infection or UTI)
পেশীর শক্তি কমে যাওয়া (reduced muscle mass)
গাঁটে ব্যাথা (painful or stiff joints)
হাড়ের ওজন কমে যাওয়া (reduced bone mass)
স্তনের আকার ছোট হয়ে যাওয়া (less full breast)
চুল পড়া (hair fall)
মুখ, গলা, পিঠ ও বুকে অবাঞ্ছিত লোম (hair growth in face, upper back and chest)
মেনোপজ হলে কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে?
ভালভোভ্যাজাইনাল অ্যাট্রফি (vulvovaginal atrophy)
ডিসপ্যারেইউনিয়া বা কষ্টকর যৌন সঙ্গম (dyspareunia or painful intercourse)
অষ্টিওপেরসিস বা হাড় নরম বা দুর্বল হয়ে যাওয়া (osteoporosis or weak or soft bones)
হঠাৎ করে মুডের পরিবর্তন (sudden changes in mood or emotions)
পেরিওডোন্টাল ডিজিজ (periodontal disease)
ওভার অ্যাকটিভ ব্লাডার (over active bladder)
হার্ট বা রক্ত জালিকার অসুখ (heart or blood vessel disease)
কেন হয় মেনোপজ (why does Menopause occur?)
বয়সের সাথে সাথে আপনার ওভারি বা ডিম্বাশয়ও বুড়ো হয়ে যায়। তখন ডিম্বাশয় থেকে কম পরিমাণে প্রজননকারী হরমোন নিঃসৃত হয়। কয়েকটি হরমোন আছে যেমন এস্ট্রোজেন (estrogen), প্রোজেসটেরন (progesterone), টেস্টটোস্টেরন (testosterone), ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (follicle stimulating hormone) বা এফএসএইচ (FSH), লিউটেনাইজিং (luteinizing) হরমোন বা এলএইচ (LH) এগুলোর নিঃসরণ কমে গেলে শরীর অন্যভাবে তার প্রতিক্রিয়া জানায়। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন দেখা যায় সক্রিয় ওভারিয়ান ফলিকলে। এই ওভারিয়ান ফলিকলই ওভারি বা ডিম্বাশয়ের দেওয়াল থেকে ডিম্বাণু মুক্ত করে এবং প্রজনন ক্ষমতা ধরে রাখে। মোটামুটি মধ্য চল্লিশে বা চল্লিশের কোঠার শেষ দিকে ঋতুস্রাব অনিয়মিত হয়ে যায়। সেটা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। তখন থেকেই মেনোপজের লক্ষণ শুরু হয়ে যায়। ৫২ বছরের মধ্যে বেশিরভাগ মহিলারই মেনোপজ হয়ে যায়।
কীভাবে মোকাবিলা করবেন? (how to cope up with menopause)
রাত্রে ঢিলেঢালা একটু মোটা পোশাক পরে শোবেন এতে হট ফ্লাশ ম্যানেজ করা অনেক সহজ হবে।
রাত্রে শোয়ার আগে ঘর ঠাণ্ডা করে নেবেন। বেশি মোটা কম্বল নেবেন না। এতে নাইট সোয়েট কম হবে। এগুলো করার পরেও নাইট সোয়েট হলে বিছানায় একটা ওয়াটার প্রুফ শিট বিছিয়ে নেবেন। এতে বিছানার চাদর নষ্ট হবে না।বাইরে বেরোলে পোর্টেবল ফ্যান নিয়ে যেতে পারেব। ফ্লাশিংএর সমস্যা এতে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ২০ থেকে ৩০ মিনিট এক্সারসাইজ করুন। খেয়াল রাখুন আপনি যেন প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৬০০ ক্যালোরির বেশি খাবার না খান। এতে আপনার বাড়তি ওজন অনেকটাই নিয়ন্ত্রের মধ্যে থাকবে। ক্যালোরি গ্রহন সীমার মধ্যে থাকলে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করলে আপনার এনার্জি অনেক বাড়বে, রাত্রে ঘুম ভালো হবে, হঠাৎ করে মুড বা আবেগের যে পরিবর্তন হচ্ছিল সেটা হবে না, অনেক ফুরফুরে ও সতেজ থাকবেন।
মেনোপজের সঙ্গে কিছু মানসিক সমস্যাও জড়িত আছে সেটা আগেও বলেছি। এই বিষয়ে প্রথমেই আপনাকে যারা সাহায্য করতে পারেন তারা হল আপনার পরিবারের লোকজন। তাদের সঙ্গে কথা বলুন, বেশি করে সময় কাটান। পরিবারের বাইরেও যারা আপনার প্রিয়জন আছেন, আপনার বন্ধু বান্ধব এবং সহকর্মীদের সঙ্গে এ বিষয়ে নিঃসঙ্কোচে খোলাখুলি কথা বলুন। আপনার বাড়ির দেওয়ালে কী রঙ করাবেন বা ভাইঝির বিয়েতে কি উপহার দেবেন বা কি পরে যাবেন সেটা যেমন খোলা মনে অনেকের সঙ্গেই আলোচনা করেন বা পরামর্শ নেন, এটা ঠিক তাই।তবে প্রয়োজন হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলতে ভুলবেন না।
কাজ দেবে মেডিটেশানে
ঘুমের সমস্যা, হাড় নরম হওয়ার সমস্যা এবং এনার্জি কমে যাওয়ার যে সমস্যা মেনোপজের সঙ্গে জড়িত তার জন্য অবশ্যই আপনার ডায়েটে (diet) যেন ক্যালসিয়াম (calcium), ভিটামিন ডি (vitamin D) ও ম্যাগনেসিয়াম (magnesium) থাকে।এই তিনটে নিউট্রিয়েন্ট প্রতিদিনের খাবারে থাকলে এই তিনটি সমস্যা অনেকটাই কম হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়াও যদি আপনার প্রতিদিনের খাবারে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ভিটামিন ই থাকে তাহলেও মেনোপজের অনেক সমস্যাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
নিজেকে রিল্যাক্স বা নিয়ন্ত্রিত রাখার জন্য ধ্যান করুন। যোগা, বক্স ব্রিদিং এবং মেডিটেশান এক্ষেত্রে খুব ভালো কাজ দেয়। প্রত্যেকদিন সকালে নিয়ম করে ধ্যান করলে অবসাদ, অস্থিরতা ইত্যাদি বিষয়গুলো অনেক কমে যাবে। আপনি মনে অনেক বেশি জোর পাবেন।
উপভোগ করুন জীবনের আনন্দ
আগেই বলেছি হরমোন নিঃসরণ কমে যায় বলে ত্বক এই সময় শুষ্ক হয়ে পড়ে। প্রতিদিন নিয়ম করে ময়েশ্চারাইজার লাগাতে ভুলবেন না। সারা বছর এই আর্দ্রতা আপনার ত্বককে দিতে থাকুন। বেশি বার স্নান করা বা সাঁতার কাটা বন্ধ করুন।
মেনোপজের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও একটি বড় সমস্যা হল ঘুম। এই সময় অনেক মহিলাই অনিদ্রায় ভোগেন। যদি এই সমস্যা মাঝে মাঝে হয় তাহলে অল্প ডোজের ঘুমের ওষুধ খেতে পারেন। তবে যে কোনও ওষুধ নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। তিনিই আপনাকে গাইড করতে পারবেন এ বিষয়ে। কারণ অনিদ্রার এই সমস্যাটি অনেক সময় এমনিই ঠিক হয়ে যায়। তাই এটা নিয়ে এত চিন্তিত হওয়ার কোনও দরকার নেই।
এই সময় বেশি ধূমপান বা অতিরিক্ত মদ্যপান না করাই মঙ্গল। সিগারেট ও মদ এই সময় আপনার শরীরের আর অনেক বেশি ক্ষতি করতে পারে। তাই এই ব্যাপারে একটু সচেতন থাকবেন। আগে থেকে ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যেস থাকলে এই বিষয়ে নিজের পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নেবেন।
মেনোপজ নিয়ে ধারণার পরিবর্তন করুন (Change your perception about Menopause)
এগিয়ে চলুন ভবিষ্যতের দিকে
পেলভিক বা ওভারিয়ান কোনও ড্যামেজ না হলে মোটামুটি ৫২ বছর বয়সের মধ্যে প্রত্যেক মহিলারই মেনোপজ হয়। এক সময় যে ঋতুস্রাব শুরু হয়েছিল সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে জীবন শেষ হয়ে গেল। ভালো ভালো বই পড়ুন, গান শুনুন, বেড়াতে যান। স্বাস্থ্যকর খাবার খান। নিজেকে সময় দিয়ে নিজেকে যত্নে রাখুন। মনে রাখবেন সবার আগে আপনি একজন মানুষ। নিজেকে ভালবাসতে ও মর্যাদা দিতে শিখুন। মেনোপজ হয়েছে বলে ভেঙে না পড়ে নতুনভাবে এগিয়ে চলুন ও অন্যদের সাহস জোগান।
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!