সিংহভাগ মহিলাই ত্বকের পরিচর্যায় প্রাকৃতিক উপাদানের পরিবর্তে নানাবিধ বাজার চলতি কসমেটিক্সের উপরই ভরসা রাখতে বেশি পছন্দ করেন। তাতে উপকার মেলে বৈকি! কিন্তু তা চিরস্থায়ী হয় না। বরং কিছু সময়ের জন্য মেকআপের নিচে ত্বকের আসল অবস্থাকে আমরা ঢেকে রাখতে পারলেও একদিন না একদিক তা সামনে চলে আসেই। এই কারণেই তো বিশেষজ্ঞরা কসমেটিক্সের পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপদানের উপর বেশি মাত্রায় ভরসা রাখার পরামর্শ দেন। বিশেষত, বিটরুটের মতো সবজিকে যদি ত্বকের পরিচর্যায় কাজে লাগানো যায়, তাহলে তো কথাই নেই।
কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন এ,সি, ক্যালসিয়াম এবং আয়রন সমৃদ্ধ এই প্রাকৃতিক উপাদানটিকে (Beetroot) ত্বকের পরিচর্যায় কাজে লাগাতে শুরু করলে স্কিনের ভিতরে পুষ্টির ঘাটতি দূর হওয়ার কারণে ভিতর থেকে ত্বকের সৌন্দর্য (Beetroot Benefits For Skin) বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে আরও অনেক উপকার মেলে।
বিটরুট নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর
প্রথমত মাত্রাতিরিক্ত কসমেটিক্স ব্যবহারের কারণে যেমন ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তেমনি স্কিন টোনের অবনতি ঘটার পিছনে আরও কিছু কারণ দায়ী থাকে। যেমন ধরুন…
দিনের বেশিরভাগ সময় যদি গায়ে রোদ লাগে, তাহলে ত্বকের ভিতরে মেলানিন নামক একটি উপাদানের মাত্রা বাড়তে শুরু করে, যা অতিরিক্ত মাত্রায় সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মিকে শোষণ করতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ত্বকের সৌন্দর্য তো কমেই, সেই সঙ্গে নানাবিধ ত্বকের রোগ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কাও যায় বেড়ে। তবে এখানেই শেষ নয়, ত্বকের সৌন্দর্য কমে যাওয়ার পিছনে পরিবেশ দূষণেও কিন্তু বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। আসলে পরিবেশে উপস্থিত নানাবিধ ক্ষতিকর উপাদান ত্বকের এত মাত্রায় ক্ষতি করে যে ত্বক নির্জীব এবং রুক্ষ হয়ে যায়।
ব্রণ বা অন্য কোনও কারণে অনেক সময় ত্বকে দাগ ছোপ প্রকাশ পায়। এই কারণেও অনেক সময় স্কিন টোনের অবনতি ঘটে। কিছু ক্ষেত্রে হাইপারপিগমেন্টেশনের কারণেও ত্বকের কিছু কিছু জায়গা কালো হতে শুরু করে।
হঠাৎ করে যদি বেশ কিছু হরমোনের ক্ষরণ ঠিক মতো না হয়, তাহলে মেলানিনের উৎপাদন বাড়তে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ত্বকের সৌন্দর্যের বারোটা বেজে যেতে সময় লাগে না।
নানা রোগের কারণে যেমন হরমোনাল ইমব্যালেন্স দেখা দিতে পারে, তেমনি গর্ভাবস্থার কারণও কিন্তু এমনটা হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট খেলেও একই সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই তো কী কারণে হরমোনের ক্ষরণ ঠিক মতো হচ্ছে না, তা জেনে নিয়ে সেই মতো চিকিৎসা করালেই হারিয়ে যাওয়া ত্বকের সৌন্দর্য ফিরে আসতে সময় লাগে না।
বয়স বা অন্যান্য কারণে যদি বলিরেখা প্রকাশ পেতে শুরু করে, তাহলেও কিন্তু ত্বকের সৌন্দর্য কমে চোখে পড়ার মতো। কিছু ক্ষেত্রে তো ত্বকের ইলাস্টিসিটি খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে চামড়া ঝুলে পড়তে শুরু করে। তাই যে কারণেই ত্বকের সৌন্দর্য কমে যাক না কেন, ঠিক ঠিক নিয়ম মেনে যদি নানাবিধ প্রাকৃতিক উপাদানকে ত্বকের পরিচর্যায় কাজে লাগানো যায়, তাহলে কিন্তু উপকার মিলতে সময় লাগে না। যেমন বিটরুটের কথাই ধরুন না, পুষ্টিগুণে ভরপুর এই সবজিটি নানাভাবে ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কম সময়ে ত্বকের যে কোনও সমস্যা কমে গিয়ে স্কিনের জেল্লা বাড়ুক, এমনটা যদি চান, তাহলে নিয়মিত ত্বকের যত্নে বিটরুটকে কাজে লাগাতে ভুলবেন না যেন! এমনটা করলে যে যে উপকারগুলি পাবেন, সেগুলি হল…
একটা মাঝারি মাপের বিটরুট নিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে নিন। তারপর সেগুলি ব্লেন্ডারে ফেলে রস বানিয়ে ফেলুন। এবার বিটরুটের রসটা একটা বাটিতে সংগ্রহ করে নিয়ে তুলোর সাহায্যে সারা মুখে লাগিয়ে কম করে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন। সময় হলে গেলে কোনও মাইল্ড ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
সপ্তাহে ১-২ বার এইভাবে ত্বকের যত্ন (skin care) নিলে স্কিনের ভিতরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা বাড়তে শুরু করবে, যে কারণে ক্ষতিকর টক্সিক উপাদানেরা সব ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে বলিরেখা তো কমবেই, সেই সঙ্গে ত্বক টানটান হয়ে উঠবে। ফলে শরীরের বয়স বাড়লেও ত্বকের বয়স বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আর থাকবে না।
বিটরুটে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় ভিটামিন সি, যা ত্বকের ভিতরে প্রবেশ করা মাত্র স্কিন সেলের উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে। ফলে যে কোনও ধরনের দাগ মিলিয়ে যেতে যেমন সময় লাগে না, তেমনি ত্বকের জেল্লাও বাড়ে চোখে পড়ার মতো। শুধু তাই নয়, স্কিন পিগমেন্টটেশনের মতো সমস্যা দূর করতেও বিটরুট বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে (beetroot juice for pigmentation)। প্রথমে পরিমাণ মতো বিটরুট নিয়ে রস বানিয়ে নিতে হবে। তারপর তা ধীরে ধীরে সারা মুখে তা লাগিয়ে কিছু সময় অপেক্ষা করার পরে ধুয়ে ফেলতে হবে। তবে বিটরুটের রসকে মুখে লাগানোর পাশাপাশি যদি নিয়মিত পান করা যায়, তাহলেও কিন্তু সমান উপকার মেলে।
শরীরের ভিতরে জলের ঘাটতি দেখা দেওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমনি ত্বকের আর্দ্রতা কমতে শুরু করলেও চিন্তার বিষয। কারণ সেক্ষেত্রে স্কিন শুষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণে একদিকে যেমন ত্বকের জেল্লা কমতে শুরু করে, তেমনি ড্রাই স্কিনের কারণে বেশ কিছু ত্বকের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও যায় বেড়ে। এই কারণেই তো রোজের ডায়েটে বিটরুটের জুসকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। নিয়মিত বিটের রস পান করলে ত্বক এবং শরীরের ভিতরে জলের ঘাটতি তো দূর হয়ই, সেই সঙ্গে পুষ্টির ঘাটতি মিটতেও সময় লাগে না।
মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেস এবং দিনের পর দিন ঠিক মতো ঘুম না হওয়ার কারণে চোখের তলায় কালি পড়ে। আর এমনটা হলে দেখতে বেজায় খারাপ লাগে। কিন্তু প্রশ্ন হল ডার্ক সার্কেলের থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে? এক্ষেত্রে ত্বকের পরিচর্যায় বিটরুটকে কাজে লাগালেই দেখবেন কেল্লা ফতে! নিয়মিত চোখের তলায় বিটরুটের রস লাগালে অল্প সময়েই চোখের নিচের কালি মিলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে ত্বক নরম এবং তুলতুলে হয়ে ওঠে।
একথা ঠিক যে ঠোঁটের সৌন্দর্য বাড়াতে বাস্তবিকই বিটরুটের কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে। এক্ষেত্রে প্রতিদিন রাতে শুতে যাওয়ার আগে বিটরুটের রস অল্প করে ঠোঁটে লাগিয়ে নিতে হবে। এমনভাবে কয়েক দিন ঠোঁটের যত্ন নিলেই দেখবেন লিপস নরম তুলতুলে হয়ে উঠবে, সেই সঙ্গে গোলাপি আভাও লাগবে ঠোঁটে। ফলে সার্বিকভাবে ঠোঁটের সৌন্দর্য যে বৃদ্ধি পাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যদি বিটের রসের সঙ্গে গাজরের রসকে মিশিয়ে সেই মিশ্রণ মুখে লাগাতে পারেন, তাহলে দেখবেন স্কিন টোনের উন্নতি ঘটতে একেবারেই সময় লাগবে না (benefits of beetroot juice and carrot juice)।
গরমকালে বাড়ি থেকে বেরলেই ত্বক ট্যান হয়ে যায়। এক্ষেত্রে যদি বিটরুটকে কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে কিন্তু বেশ উপকার পাবেন। আসলে এই প্রাকৃতিক উপাদানটিতে এত রকমের পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে যে তা স্কিনের ভিতরে প্রবেশ করা মাত্র নতুন স্কিন সেলের উৎপাদন বাড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে আরও কিছু পরিবর্তন হয়, যে কারণে ত্বক ডি-ট্যান হতে সময় লাগে না।
এমন উপকার পেতে ১ চামচ বিটরুটের জুসের সঙ্গে ১ চামচ দই মিশিয়ে তৈরি করে ফেলতে হবে একটা পেস্ট। তারপর তা ত্বকের যেখানে যেখানে পুড়ে গেছে, সেখানে লাগিয়ে কিছুক্ষণ মাসাজ করতে হব। এরপরে ২০-২৫ মিনিট অপেক্ষা করে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। এই ফেসপ্যাকটি সপ্তাহে ২ বার করে মুখে লাগালেই দেখবেন উপকার মিলতে শুরু করেছে।
অল্প সময়েই ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ুক, এমনটা যদি চান, তাহলে ৩ চামচ দইয়ের সঙ্গে ৪ চামচ বিটরুটের রস মিশিয়ে ফেলুন ঝটপট। তারপর তুলোর সাহায্যে সেই মিশ্রণটি ধীরে ধীরে সারা মুখে এবং গলায় লাগিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। ৮-১০ মিনিট পরে হলকা গরম জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন মুখ। এইভাবে এক দিন অন্তর অন্তর যদি ত্বকের যত্ন নেওয়া যায়, তাহলে দেখবেন ফল মিলবে একেবারে হাতে-নাতে!
যাদের ত্বক তেলতেলে তাদের লোমকূপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তো বটেই, সেই সঙ্গে আরও নানা কারণে ব্রণর মতো ত্বকের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যায় বেড়ে। এক্ষেত্রে ত্বকের যত্নে যদি বিটরুটকে কাজে লাগানো যায়, তাহলে কিন্তু দারুন উপকার মেলে। কারণ বিটরুটে উপস্থিত নানাবিধ উপকারী উপাদান একদিকে যেমন অতিরিক্ত তেলের উৎপাদন যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখে, তেমনি এই প্রাকৃতিক উপাদানে উপস্থিত অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল উপাদান ব্রণ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের মেরে ফেলে। ফলে ব্রণর মতো সমস্যা ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না। সেই সঙ্গে অন্যান্য নানা ধরনের ত্বকের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে।
এমন সব উপকার পেতে সম পরিমাণে বিটরুটের জুস এবং টমেটোর রস নিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর সেই মিশ্রণটি সারা মুখে লাগিয়ে ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না মিশ্রণটি একেবারে শুকিয়ে যায়। এমনটা হওয়া মাত্র মুখ ধুয়ে নিতে হবে। প্রায়দিনই এই ফেসপ্যাকটি মুখে লাগাতে শুরু করলে ব্রণ তো দূরে থাকবেই, সেই সঙ্গে যে কোনও ধরনের ত্বকের দাগ মিলিয়ে যেতেও সময় লাগবে না।
এই প্রাকৃতিক উপাদানটি সম্পর্কিত আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম আমরা…
১. প্রতিদিন কি ত্বকের যত্নে বিটরুটের রসকে কাজে লাগানো যেতে পারে?
একেবারেই! আসলে বিটরুট যেহেতু একটি প্রাকৃতিক উপাদান, তাই প্রতিদিন বিটরুটের ফেসপ্যাক ব্যবহার করলে ত্বকের তো কোনও ক্ষতি হয়ই না, উল্টে নানাবিধ উপকার পাওয়া যায়।
২. স্কিন কেয়ারের পাশপাশি আর কী কী কাজে আসতে পারে বিটরুট?
বিশেষজ্ঞদের মতে রোজের ডায়েটে বিটরুটের রসকে অন্তর্ভুক্ত করলে একাধিক উপকার পাওয়া যায়। বিশেষত, লিভার ফাংশনের উন্নতি ঘটে। সেই সঙ্গে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, শরীরের ভিতরে প্রদাহের মাত্রা কমে, ক্লান্তি দূর হয়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং শরীরে উপস্থিত টক্সিক উপদান বেরিয়ে যায়।
৩. চুলের যত্নেও কি বিটরুটের জুসকে কাজে লাগানো যেতে পারে?
অবশ্যই যেতে পারে! একদিন অন্তর যদি বিটরুটের রস দিয়ে চুল ধোয়া যায়, তাহলে স্ক্যাল্পের ভিতরে পটাশিয়ামের মাত্রা বাড়তে শুরু করে, যে কারণে হেয়ারফলের মাত্রা তো কমেই, সেই সঙ্গে চুলের জেল্লা বাড়ে চোখে পড়ার মতো।
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!
এগুলোও আপনি পড়তে পারেন
সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এলোভেরার এই ১২টি গুন অবশ্যই জানুন