গরমকালে চটজলদি তেষ্টা মেটাতে এক গ্লাস ঠান্ডা আখের রসের যে কোনও বিকল্প হয় না, তা তো বলাই বাহুল্য! এই কারণেই তো কলকাতা সহ আশেপাশের অঞ্চলে বছরের এই বিশেষ সময়ে আখের রসের বিক্রি একেবারে আকাশ ছোঁয়। তবে এই পানীয়টি যে শুধু তেষ্টা মেটায়, এমন নয়, সেই সঙ্গে শরীরের একাধিক উপকারেও লাগে। বিশেষত, বেশ কিছু জটিল রোগকে দূরে রাখতে আখের রস (Health Benefits of Sugarcane Juice In Bengali) নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। তাই তো সারা গরমকাল জুড়ে নিয়মিত এক গ্লাস করে আখের সরবত খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা।
আখের রস খাওয়ার সময় যে যে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে
এত দূর পড়ার পরে নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে মনে যে আখের রসে এমন কী রয়েছে, যা এত রকমের উপকার করতে সক্ষম? আসলে এই প্রাকৃতিক উপাদনটিতে মজুত রয়েছে প্রচুর মাত্রায় কর্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, জিঙ্ক, পটাশিয়াম, ভিটামিন এ, বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি এবং আরও নানা ধরনের পুষ্টিকর উপাদান, যা শরীরে প্রবেশ করা মাত্র প্রতিটি অঙ্গের ক্ষমতা এতটাই বেড়ে যায় যে রোগ-ব্যাধি দূরে পালাতে সময় লাগে না।
অল্প সময়েই ত্বকের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি আরও একাধিক উপকারে লাগে আখের রস (Sugarcane Juice)। যেমন ধরুন…
নিয়মিত ত্বকের পরিচর্যায় যদি আখের রসকে কাজে লাগানো যায়, তাহলে ব্রণর মতো ত্বকের সমস্যার প্রকোপ কমতে একেবারেই সময় লাগে না। তাই আপনিও যদি এমন সমস্যার শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে পরিমাণ মতো মুলতানি মাটি নিয়ে তার সঙ্গে আখের রস মিশিয়ে একটা পেস্ট বানিয়ে ফেলুন। তারপর সেই মিশ্রণটি ধীরে ধীরে সারা মুখে এবং ঘাড়ে লাগিয়ে কম করে ২০ মিনিট অপেক্ষা করুন। সময় হয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন পেস্টটা।
নিয়মিত যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সপ্তাহে কম করে ২ দিন এই ফেসপ্যাকটি মুখে লাগাতে হবে। এমনটা করলে ত্বকের ভিতরে বিশেষ এক ধরনের অ্যাসিডের মাত্রা বাড়তে শুরু করবে, যে কারণে ব্রণর প্রকোপ তো কমবেই, সেই সঙ্গে নতুন কোষের উৎপাদন এতটাই বেড়ে যাবে যে নানা ধরনের দাগ মিলিয়ে যেতেও দেখবেন সময় লাগবে না। সেই সঙ্গে মুলতানি মাটি ত্বকের উপরে জমতে থাকা মৃত কোষের আবরণকে সরিয়ে ফেলে। ফলে ত্বকের জেল্লা বৃদ্ধি পায়।
বলিরেখা প্রকাশ পাওয়ার কারণে কি চিন্তায় রয়েছেন? তাহলে আজ থেকেই ত্বকের যত্নে আখের রসকে (sugarcane juice) কাজে লাগাতে শুরু করুন, দেখবেন উপকার পাবেই পাবেন। কারণ আখের রসে মজুত রয়েছে প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফ্লেবোনয়েড এবং ফেনোলিক অ্যাসিড, যা বলিরেখা কমাতে যেমন বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, তেমনি অল্প সময়েই ত্বক নরম এবং তুলতুলে হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে স্কিনের হারিয়ে যাওয়া আর্দ্রতা ফিরে আসতেও সময় লাগে না।
এতসব উপকার পেতে নিয়মিত আখের রস যেমন খেতে হবে, তেমনি সম্ভব হলে তুলোর সাহায্যে নিয়মিত আখের রস মুখে লাগাতে হবে। এমনটা করলে দেখবেন ফল মিলবে একেবারে হাতে-নাতে!
একাধিক ভিটামিন এবং মিনারেলে ঠাসা আখের রসকে যদি রোজের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে শরীরের ভিতরে এমন কিছু বদল আসতে শুরু করে যে তার প্রভাবে একাধিক উপকার মেলে। যেমন…
গরমকালে অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়তে সময় লাগে না। আর সে সময় যদি এক গ্লাস আখের রস পান করা যায়, তাহলে কিন্তু দারুন উপকার মেলে। আসলে আখের রসে রয়েছে সুক্রোজ বা “সিম্পল সুগার”, যা রক্তে মিশে যাওয়া মাত্র ক্লান্তি দূর হয়, সেই সঙ্গে সার্বিকভাবে শরীরের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেতেও সময় লাগে না।
মুখের বদ গন্ধ দূর করার পাশাপাশি দাঁতের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতেও আখের রসের কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে। কারণ এতে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস, যা দাঁতের এনামেল স্তরকে শক্তপোক্ত করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া বা ক্যাভিটি হওয়ার মতো সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না বললেই চলে।
আখের রসে উপস্থিত নানাবিধ পুষ্টিকর উপদানের কারণে দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া আর জন্ম নিতে পারে না। ফলে মুখ থেকে বাজে গন্ধ বেরনোর মতো সমস্যা কমে যেতেও সময় লাগে না।
বুড়ো বয়সে গিয়ে নানা ধরনের হাড়ের রোগে আক্রান্ত হতে যদি না চান, তাহলে এখন থেকেই নিয়মিত আখের রস খাওয়া শুরু করুন। এমনটা করলে শরীরে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হাড় এতটাই শক্তপোক্ত হয়ে উঠবে যে হাড় সম্পর্কিত কোনও ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আর থাকবে না। এই একই কারণেই তো বাচ্চাদের নিয়মিত আখের রস খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। আসলে ছোট থেকেই হাড়ের গঠন ঠিক মতো হলে বড় বয়সে এসে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যে আর থাকে না, তা তো বলাই বাহুল্য!
এক গ্লাস আখের রসে অল্প করে লেবুর রস মিশিয়ে যদি দিনে দু-গ্লাস করে খাওয়া যায়, তাহলে লিভার ফাংশনের উন্নতি ঘটতে সময় লাগে না। সেই সঙ্গে শরীরের ভিতরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় থাকে। ফলে লিভারের কোনও ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আর থাকে না। তাই তো বলি, দেহের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির কর্মক্ষমতা কমে যাক, এমনটা যদি না চান, তাহলে নিয়মিত আখের রস খেতে ভুলবেন না যেন!
খাদ্যরসিক হওয়ার কারণে বদ হজম এবং গ্যাস-অম্বলের সমস্যা তো বাঙালিদের প্রায় রোজের সঙ্গী। উপরন্তু এই গরমকালে প্রচন্ড তাপদাহের প্রভাবে হজম ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো ঘটনা তো প্রায়ই ঘটে থাকে। এই কারণেই তো বছরের এই বিশেষ সময়ে আরও বেশি করে আখের রস খাওয়া উচিত। কারণ এতে রয়েছে পটাশিয়াম, যা শরীরে প্রবেশ করা মাত্র “পিএইচ লেভেল” ঠিক হতে শুরু করে, সেই সঙ্গে হজমে সহায়ক পাচক রসের ক্ষরণও ঠিক মতো হতে থাকে। ফলে হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটতে তো সময় লাগেই না, সেই সঙ্গে গ্যাস-অম্বল এবং বদ হজমের মতো সমস্যাও কমে যায়।
শুনতে আজব লাগলেও একতা ঠিক যে ক্যান্সারের মতো রোগকে দূরে রাখতে আকের রস নানাভাবে সাহায্যে করে থাকে। বিশেষত প্রস্টেট এবং ব্রেস্ট ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করতে এই প্রাকৃতিক উপাদানটির কোনও বিকল্প হয় না বললেই চসে। আসলে আখের রসে উপস্থিত ফ্লেবোনয়েড, শরীরের কোনও অংশেই যাতে ক্যান্সার সেল জন্ম নিতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই মারণ রোগের খপ্পরে পড়ার আশঙ্কা যায় কমে।
হঠাৎ করে কি গলায় খুব ব্যথা হচ্ছে? তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এক গ্লাস আখের রস খেয়ে ফেলুন, দেখবেন উপকার মিলবে সঙ্গে সঙ্গে। আসলে আখের রসে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া এবং জীবাণুদের মেরে ফেলে। ফলে গলার ব্যথা কমে যেতে সময় লাগে না।
নিয়মিত এক গ্লাস করে আখের রস খাওয়া শুরু করলে শরীরে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটতে সময় লাগে না। আর ইমিউনিটি যখন একবার বেড়ে যায়, তখন ছোট-বড় কোনও রোগের পক্ষেই আর শরীরের ক্ষতি করে ওঠা সম্ভব হয় না।
এখানেই শেষ নয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ক্ষতের চিকিৎসাতেও আখের রসকে কাজে লাগালে দারুন উপকার মেলে। এক্ষেত্রে ক্ষতের উপরে অল্প করে আখের রস লাগাতে হবে, তাহলেই উপকার মিলবে!
অল্প সময়েই কয়েক কিলো ওজন ঝরিয়ে ফেলতে নিয়মিত শরীরচর্চা করার পাশাপাশি কয়েক গ্লাস করে আখের রস খেতে ভুলবেন না যেন! আসলে এমনটা করলে শরীরে ফাইবারের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেবে, যে কারণে বহুক্ষণ পেট ভরা থাকবে। আর খিদে না পেলে স্বাভাবিকভাবেই খাওয়ার পরিমাণ কমতে শুরু করবে। আর এমনটা হলে ওজন কমতে যে সময় লাগবে না!
আমাদের অজান্তেই নানাভাবে টক্সিক উপাদানেরা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। আর এই সব বিষাক্ত উপাদানগুলি রক্তে মিশে যাওয়া মাত্র ধীরে ধীরে শরীরের ক্ষতি করতে শুরু করে। বিশেষত, দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির মারাত্মক ক্ষতি করে দেয়। তাই তো দেহে যাতে টক্সিক উপাদানের মাত্রা বেড়ে না যায়, তা সুনিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। আর এই কারণেই তো নিয়মিত আখের রস খাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
আখের রসে রয়েছে এমন কিছু উপাদান, যা শরীরে প্রবেশ করার পরে এই সব ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান ধ্বংস করতে শুরু করে। ফলে দেহের কোনও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আর থাকে না।
একেবারেই ঠিক শুনেছেন! নিয়মিত আখের রস, লেবু এবং ডাবের জল মিশিয়ে যদি খাওয়া যায়, তাহলে শরীরে উপস্থিত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সব মারা যায়। ফলে শুধু ইউটিআই নয়, যে কোনও ধরনের সংক্রমণের প্রকোপ কমে যেতেই সময় লাগে না। সেই সঙ্গে কিডনির ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
আখের রস যে বেজায় উপকারী, তা তো এতক্ষণে জেনেই ফেলেছেন! কিন্তু এই পানীয়টি খাওয়ার সময় কতগুলি বিষয় মাথায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। যেমন-
১| আখের রস খেতে ইচ্ছা হলে বাড়িতে বানিয়ে খাবেন। কারণ রাস্তায় বিক্রি হওয়া এই পানীয়টি কতটা হাইজেনিক ভাবে তৈরি করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এমন পানীয় পান করলে শরীরে নানাবিধ ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা যে বাড়ে, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না!
২| আখের রস বানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা খেয়ে নেওয়া উচিত। কারণ অনেকটা সময় রেখে যদি তা খাওয়া হয়, তাহলে পেট খারাপ হওয়ার আশঙ্কা যায় বেড়ে। এমনকী এমনটাও অনেকে বলে থাকেন যে ফ্রিজ থেকে বার করার ১৫ মিনিটের মধ্যে আখের রস খাওয়া উচিত, না হলে তা শরীরের কোনও উপকরারেই লাগে না।
৩| রাস্তায় বিক্রি হওয়া আখের রস খাওয়ার আগে আরেকটা জিনিস খেয়াল রাখা উচিত। তা হল যে মেশিনে আখটা পেষা হচ্ছে, তাতে যদি অতিরিক্ত মাত্রায় তেল দেওয়া থাকে, তাহলে সেই তেল আখের রসের সঙ্গে মিশে আমাদের শরীরে এসে পৌঁছায়। ফলে শরীর খারাপ হওয়ার আশঙ্কা যায় বেড়ে।
ছবির কৃতজ্ঞতা স্বীকার: youtube,wikipedia
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!