“এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স” অনুযায়ী কলকাতা শহরে যে হারে বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়ছে, তাতে শরীরের উপর যে ভীষণ রকমের খারাপ প্রভাব পরছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া না করার কারণেও স্বাভাবিকভাবেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে হার্ট অ্যাটাক, ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস এবং কোলেস্টেরলের মতো রোগ। পিছিয়ে নেই ক্যান্সারও। তাই এমন পরিস্থিতিতে সুস্থ থাকতে নানাবিধ প্রাকৃতিক উপাদানের উপর ভরসা না রাখলে কিন্তু চলবে না। আর ঠিক এই কারণেই রোজের ডায়েটে সরিষা বীজকে (Mustard Seed) অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
আরো পড়ুনঃ শরীর সুস্থ রাখতে জায়ফলের উপকারিতা
ত্বক এবং চুলের যত্নে সরিষা বীজ
সরিষা বীজ কেনার সময় যে বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে
কীভাবে কাজে লাগাতে হবে সরিষা বীজ
নানাবিধ উপকারি ফ্যাট, ডায়াটারি ফাইবার, ভিটামিন সি,এ,ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম,ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং আয়রনে ঠাসা এই প্রাকৃতিক উপাদানটি নিয়মিত খাওয়া শুরু করলে একাধিক শারীরিক উপকার (Benefits Of Mustard Seeds) পাওয়া যায়। যেমন ধরো…
২০১৮ সালে প্রায় ৭,৮৪,৮২১ জন মানুষ এমন মারণ রোগের খপ্পরে পরে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে ৪,১৩,৫১৯ পুরুষ এবং ৩,৭১,৩০২ জল মহিলা। তবে এখানেই শেষ নয়, বিশেষজ্ঞদের মতে গত কয়েক বছরে যে হারে ক্যান্সার রোগে (Cancer) আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে, তাতে ২০২০ সালে আমরা যে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চলেছি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর এই কারণেই পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষ সবারই নিয়মিত সরিষা বীজ (Mustard Seed) খাওয়া উচিত। আসলে সরিষা বীজে রয়েছে গ্লকোসিনোলেট (Glucosinolates) নামক একটি উপাদান, যা শরীরে প্রবেশ করা মাত্র ক্যান্সার (Cancer) কোষেদের ধ্বংস করতে শুরু করে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এমন মারণ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না বললেই চলে।
একেবারে ঠিক শুনেছো! বাস্তবিকই বাতের ব্যথা (Arthritis) কমাতে এই প্রাকৃতিক উপাদানটির (Mustard Seed) কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে। কারণ এতে উপস্থিত সেলেনিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম সহ একাধিক অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান শরীরে প্রবেশ করা মাত্র এমন কিছু পরিবর্তন হতে শুরু করে যে তার প্রভাবে দেহের ভিতরে প্রদাহের মাত্রা কমতে সময় লাগে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যে কোনও ধরনের যন্ত্রণা কমে নিমেষে। ঠিক এই কারণেই তো ব্যথা হলেই সরিষার তেল (Mustard Oil) দিয়ে মাসাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে সরিষার বীজে মজুত রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম, যা এমন ধরনের রোগের প্রকোপ কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই তো বলি, মাইগ্রেনের (Migraine) সমস্যার কারণে যদি চিন্তায় থাকো, তাহলে নিয়মিত সরিষা বীজ (Mustard Seed) খেতে ভুলো না যেন!
আমরা, মানে বাঙালিরা হল গিয়ে জাত খাদ্যরসিক! তাই তো এদিক-সেদিকের টক-ঝাল খাবার খেতে খেতে এক সময়ে গিয়ে আমাদের হজম ক্ষমতার বারোটা বেজে যেতে যে সময় লাগে না, তা তো বলাই বাহুল্য! তাই তো বাঙালিদের রোজের ডায়েটে সরিষা বীজ (Mustard Seed) থাকা চাইই চাই। কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ডায়াটারি ফাইবার, যা হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি গ্যাস-অম্বল এবং কনস্টিপেশনের মতো সমস্যা কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু তাই নয়, শরীরে ফাইবারের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে খিদে কমে যায়। ফলে কম পরিমাণে খাওয়ার কারণে ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে সময় লাগে না। সেই সঙ্গে কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস এবং কোনও ধরনের লিভারের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও যায় কমে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী আজকের ডেটে তিন জন ভারতীয়ের মধ্যে এক জন করে উচ্চ রক্তচাপের (Blood Pressure) মতো মারণ রোগের শিকার। তাই বুঝতেই পারছো বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু মোটেও সুবিধের নয়। তাই এমন মারণ রোগের খপ্পরে যদি পরতে না চাও, তাহলে নিয়মিত সরিষা বীজ খেতে ভুলো না যেন! কারণ এমনটা করলে শরীরের ভিতরে কপার এবং আয়রনের পাশাপাশি ম্যাগনেসিয়াম এবং সেলেনিয়ামের মাত্রাও বাড়তে শুরু করে, যে কারণে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে সময় লাগে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে নিয়মিত সরিষা বীজ (Mustard Seed) খাওয়া শুরু করলে কপার, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন এবং সেলেনিয়ামের ঘাটতি মিটতে সময় লাগে না। আর এই সবকটি উপাদানই ফুসফুসের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর একবার এই এই বিশেষ অঙ্গটির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে একদিকে যেমন অ্যাস্থেমার মতো রোগের প্রকোপ কমতে সময় লাগে না, তেমনি বায়ু দূষণের কারণে শরীরের কোনও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও যায় কমে।
সরিষা বীজে (Mustard Seed) রয়েছে ওমেগা ৩ (Omega 3) ফ্যাটি অ্যাসিড, যা শরীরে প্রবেশ করা মাত্র এমন কিছু খেল দেখাতে শুরু করে, যার প্রভাবে হার্টের স্বাস্থ্যের (Heart Condition) উন্নতি ঘটতে সময় লাগে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোনও ধরনের কার্ডিও ভাসকুলার রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যেমন কমে, তেমনি হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক (Heart Attack) বা স্ট্রোক (Stroke) হওয়ার আশঙ্কাও আর থাকে না।
এক্ষেত্রে আরেকটি জিনিস জেনে রাখাও একান্ত প্রয়োজন। তা হল, চিকিৎসকেদের মতে সরিষা বীজ যেমন শরীরের নানা উপকারে লাগে, তেমনি সরিষার তেল (Mustard Oil) খাওয়া শুরু করলেও কিন্তু দারুন সব উপকার পাওয়া যায়। তাই সরিষার তেলে রান্না করার অভ্যাস ত্যাগ করো না! আর যদি সরিষার তেলের পরিবর্তে অন্য কোনও তেলে রান্না করতে মন চায়, তাহলে একবার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে ভুলো না যেন!
চিকিৎসকেদের মতে প্রায় দিনই যদি সরিষা বীজের (Mustard Seed) পাশাপাশি সরিষা পাতা খাওয়া যায়, তাহলে খারাপ কোলেস্টেরলের (Bad Cholesterol) মাত্রা কমতে সময় লাগে না। তাই তো বলি, যাদের পরিবারে এমন রোগের ইতিহাস রয়েছে, তারা সরিষা পাতা বা বীজ খেতে ভুলো না যেন!
আরও পড়ুনঃ হাই কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে তিসি বীজের উপকারিতা
একাধিক রোগকে দূরে রাখার মধ্যে দিয়ে শরীরকে চাঙ্গা রাখতে সরিষা বীজ (Mustard Seed) যেমন বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, তেমনি ত্বক (Skin) এবং চুলের (Hair) স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও এই প্রাকৃতিক উপাদানটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যেমন ধরো…
হাফ চামচ সরিষা বীজের গুঁড়ো নিয়ে তার সঙ্গে পরিমাণ মতো গোলাপ জল বা ল্যাভেন্ডার তেল মিশিয়ে একটি পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে। তরপর সেই মিশ্রণটি সারা মুখে লাগিয়ে কিছু সময় মাসাজ করতে হবে। তারপর ঠান্ডা জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে মুখ। সপ্তাহে ১-২ বার এইভাবে ত্বকের (Skin) পরিচর্যা করলে দেখবে স্কিনের উপরি অংশে জমে থাকা মৃত কোষের স্তর সরে যাবে। ফলে ত্বকের জেল্লা বাড়বে চোখে পড়ার মতো।
ত্বক শুষ্ক (Dry Skin) হয়ে যাওয়ার কারণে কি সৌন্দর্য কমেছে চোখে পড়ার মতো? তাহলে তো ত্বকের পরিচর্যায় আজ থেকেই সরিষা বীজকে (Mustard Seed) কাজে লাগানো উচিত। এক্ষেত্রে পরিমাণ মতো সরিষা বীজের গুঁড়োর সঙ্গে অ্যালোভেরা জেল মিশিয়ে মুখে লাগাতে হবে। সপ্তাহে ৩-৪ দিন এই মিশ্রণটি মুখে লাগালে দেখবে ত্বকের হারিয়ে যাওয়া আর্দ্রতা (Skin Moisturize) ফিরে আসতে সময় লাগবে না। সেই সঙ্গে বেশ কিছু ত্বকের রোগের প্রকোপও কমবে। তাই তো বলি, অল্প সময়েই ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাক, এমনটা যদি চাও, তাহলে সরিষা বীজ আর অ্যালোভেরা জেলের সাহায্যে ত্বকের যত্ন নিতে ভুলো না যেন।
সরিষা বীজে (Musterd Seed) রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ,সি,কে এবং সালফার, যা ত্বকের ভিতরে প্রবেশ করা মাত্র ক্ষতিকর জীবাণুরা মারা যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোনও ধরনের ত্বকের সংক্রমণে (Skin Infection) আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না বললেই চলে। সেই সঙ্গে বলিরেখাও উধাও হতে শুরু করে। ফলে ত্বকের বয়স কম চোখে পড়ার মতো। এবার নিশ্চয় বুঝতে পরেছো ত্বকের পরিচর্যায় এই প্রাকৃতিক উপাদানটিকে কাজে লাগানো কতটা জরুরি!
এমন ধরনের ত্বকের রোগের চিকিৎসায় সরিষা বীজের (Musterd Seed) কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে। কারণ এই প্রাকৃতিক উপাদানটিতে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল (Anti-Bacterial) উপাদান, যা এমন ধরনের স্কিন ডিজিজের (Skin Disease) প্রকোপ কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে পরিমাণ মতো সরিষা বীজ নিয়ে তার পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে। তারপর সেই পেস্ট, রিংওয়ার্মের (Ringworm) উপর লাগিয়ে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। তারপর হালকা গরম জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে পেস্ট। এইভাবে কয়েকদিন দাদের চিকিৎসা করলেই দেখবে উপকার মিলতে শুরু করেছে।
সরিষা বীজে (Musterd Seed) উপস্থিত প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ই,এ, ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ওমেগ ৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, স্ক্যাল্পের ভিতরে পুষ্টির ঘাটতি দূর করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই চুলের গোড়া এতটাই মজবুত হয়ে ওঠে যে হেয়ার ফলের মাত্রা কম হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে চুলের (Hair) সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পায় চোখে পড়ার মতো।
এমন সব উপকার পেতে সরিষা বীজ (Musterd Seed) পিষে নিয়ে একটা পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে। তারপর সেই পেস্টটা ভালো করে স্ক্যাল্পে লাগিয়ে কিছু সময় অপেক্ষা কারতে হবে। তারপর ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে চুল। এইভাবে সপ্তাহে ১-২ বার চুলের (Hair) পরিচর্যা করলে দেখবে ফল মিলবে একেবারে হাতে-নাতে!
সরিষা বীজে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় উপকারি ফ্যাটি অ্যাসিড (Fatty Acid), যা চুলের হারিয়ে যাওয়া আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনে। সেই সঙ্গে চুলের (Hair) বেজায় সুন্দর হয়ে ওঠে।
মশলা রাখার কন্টেনার থেকে কি খারাপ গন্ধ বেরচ্ছে? তাহলে কন্টেনারে অল্প করে গরম জল নিয়ে তাতে পরিমাণ মতো সরিষা বীজের পেস্ট ফেলে ভালো করে নাড়াও। কিছু সময় এমন করার পর জলটা ফেলে কন্টেনারটা ভালো করে ধুয়ে ফেলো। এমনটা করলে দেখবে নিমেষে বদ গন্ধ দূরে পালাবে।
কোনও কারণে কি পেশীতে খুব ব্যথা হচ্ছে? কোনও চিন্তা নেই! এক বালতি উষ্ণ জলে পরিমাণ মতো সরিষা বীজ (Mustard Seed) ফেলে সেই জল দিয়ে স্নান করা শুরু করো। কয়েক দিন এমনটা করলেই দেখবে কষ্ট কমে যাবে। এক্ষেত্রে ব্যথা জায়গায় সরিষার তেল (Mustard Oil) লাগিয়ে মাসাজও করলেও কিন্তু বেশ উপকার পাওয়া যায়।
১. সব সময় অর্গ্যানিক সরিষা বীজ কেনা উচিত। কারণ এমন বীজ ব্যবহার করলে দ্রুত ফল মেলে।
২. সরিষা বীজ কেনার আগে “ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট” দেখে নেওয়া উচিত। কারণ সময় পেরিয়ে গেলে সরিষা বীজের (Musterd Seed) গুণমান কিন্তু কমে যায়।
১. ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে সরিষা বীজ। না হলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।
২. এয়ার টাইট কন্টেনারে রাখা মাস্ট।
৩. সরিষা বীজের গুঁড়ো কিন্তু ছয় মাসের বেশি ভালো থাকে না। তাই সেদিকে নজর রাখাটা একান্ত প্রয়োজন।
সরিষা বীজ গুঁড়ো করে যেমন খেতে পারো, তেমনি রান্নায় বা স্যালাডে মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে। এমনকি সরিষা বীজ সহযোগে বানানো নানা পদ খেলেও কিন্তু সমান উপকার পাওয়া যায়। তাই কীভাবে খাচ্ছো, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং প্রতিদিন সরিষা বীজ খাওয়া হচ্ছে কিনা, তার উপর কিন্তু শরীর, ত্বক এবং চুলের স্বাস্থ্য কতটা ভালো থাকবে, তা কিন্তু অনেকাংশেই নির্ভর করে থাকে।
ছবির কৃতজ্ঞতা স্পীকার: Wikipedia
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!