শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ই (Sharadindu Bandyopadhyay) কি আসলে ব্যোমকেশ বক্সী (Byomkesh Bakshi)? উঁহু তা বলা ভারী কঠিন। এই যেমন বাঙালিরা বলে সত্যজিৎ রায়ের তরুণ অবস্থা হল ফেলুদা আর পরিণত অবস্থা হল প্রফেসর শঙ্কু। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি গোয়েন্দা(detective) গল্পের লেখকরা কিছুটা হলেও নিজস্ব ছায়া দেখতে চান তাদের সৃষ্ট গোয়েন্দাদের (detective) মধ্যে। আজ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (Sharadindu Bandyopadhyay) জন্মদিন। তবু এত বছর পরেও অমলিন তার সত্যান্বেষীর (Satyanweshi) জাদু। আজও তাঁর লেখা গল্প নিয়ে একের পর এক হিট ছবি হয়। আজও তাঁর ব্যোমকেশ (Byomkesh Bakshi) সমগ্র সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় থাকে।এই সুযোগে সত্যান্বেষীর (Satyanweshi) মতো আমরাও বেরিয়ে পড়লাম সত্য অন্বেষণে। উঠে এল অনেক প্রশ্ন, কিছু উত্তর মিলল কিছুর নয়।
ব্যোমকেশের ঠিকানা কি সেই বিখ্যাত মেসবাড়ি?
১৯৩৩ সালে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন হ্যারিসন রোডের কাছে একটা মেসবাড়িতে। সেখানেই প্রথম ব্যোমকেশের গল্প লেখা হয়। যার নাম ছিল সত্যান্বেষী। ডিটেকটিভ, টিকটিকি, গোয়েন্দা এই সব নাম নয়। একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, খোলা মনের মানুষ যে শুধু মিথ্যের আড়াল সরিয়ে সত্যকে খুঁজে বের করতে চায়। তাই ব্যোমকেশ বক্সীর জন্ম হল। যে ডিটেকটিভ নয়। সে সত্যান্বেষী।প্রথম দিকে ব্যোমকেশও মেসেই থাকত। পরে তার সঙ্গে থাকতে শুরু করে অজিত। লেখকের বাল্যবন্ধু অজিন সেনের ছায়া অবলম্বনে তৈরি হয় এই চরিত্র। হ্যারিসন রোড থেকে কেয়াতলায় চলে আসে ব্যোমকেশ। স্রষ্টা শরদিন্দুও বেশ কিছুদিন ছিলেন কেয়াতলায়।
ব্যোমকেশ কি শরদিন্দু? নাকি শরদিন্দুই ব্যোমকেশ?
বহু বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে শরদিন্দু বলেছিলেন ব্যোমকেশ তাঁর সেলফ প্রোজেকশান। কিন্তু তিনি তো বামুন! লেখকের কেন জানি না মনে হয়েছিল কায়স্থরা বামুনদের চেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরে! ব্যোমকেশের চেহারার সঙ্গে আশ্চর্য রকমের মিল ছিল শরদিন্দুর নিজের চেহারাতেও। লম্বা দোহারা চেহারা, চওড়া কপাল, টিকলো নাক।
কতটা শার্লক হোমস ব্যোমকেশ?
এর আগে বাংলায় যে গোয়েন্দা কাহিনি লেখা হয়নি তা নয়। বিমল-কুমার, জয়ন্ত-মানিক ছিল। তবে তারা মূলত অ্যাডভেনচারপ্রেমী। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ‘দারোগার দপ্তর’, গোয়েন্দা লেখক হিসেবে নাম ছিল পাঁচকড়ি দে আর দীনেন্দ্রকুমার রায়েরও। প্রেমেন্দ্র মিত্র নিয়ে এসেছিলেন পরাশর বর্মাকে। কিন্তু সবাইকে নস্যাত করে দিয়েছিল একটি সাদামাটা বাঙালি ছেলে। নাম ব্যোমকেশ বক্সী। শরদিন্দু বলেছিলেন তিনি অনেক ছোটবেলা থেকে গোয়েন্দা কাহিনি পড়তেন। এডগার অ্যালেন পো, আগাথা ক্রিস্টি থেকে শুরু করে আরথার কনান ডয়েল সব গুলে খেয়েছেন। অনেকেই ব্যোমকেশের গল্পে হোমসের ছায়া দেখতে পান। কিন্তু মিলের চেয়ে অমিল বেশি।শার্লক হোমস অবিবাহিত, সে মরফিয়া নিত, তার অসম্ভব মুড সুইং হত। ব্যোমকেশের এসব বালাই নেই। তবে একবার শার্লক হোমসকে মেরে ফেলেছিলেন ডয়েল। পাঠকদের বিপুল চিঠির চাপে তাকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন তিনি। এমনটা হয়েছিল ব্যোমকেশের বেলাতেও। ব্যাস, মিল বলতে ওটুকুই!
কলকাতা থেকে সোজা বম্বে
বম্বে টকিজের হিমাংশু রায় আর দেবিকারানি সিনেমার গল্প লেখার লোক খুঁজছিলেন। যাওয়ার কথা ছিল সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি রাজি হলেন না। গেলেন শরদিন্দু। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত বম্বেতে ছিলেন। ১৯৫২তে আসেন পুনায়। সে জায়গা এত ভালো লাগে বাড়িও করেন সেখানে। মারা যাওয়ার আগে একবারই এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁর বিখ্যাত সব ছোটগল্পে বার বার এসেছে বম্বে আর পুনার কথা। বিশেষ করে ‘মধু মালতী’ গল্পে পুরনো পুনার সুন্দর চিত্রকল্প এঁকেছিলেন তিনি। অনেক গল্পেই দেখা যেত গুরুত্বপূর্ণ মারাঠি চরিত্র।
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা… তাতে কী?ব্যোমকেশ মানেই এখনও বাঙালির আবেগ আর নস্টালজিয়া। ব্যোমকেশ আসলে বাঙালি মননের, রসবোধ আর চিন্তাশক্তির আশ্চর্য মিশেল। অদ্ভুত সাবলীল ও ঝরঝরে লেখনীই শুধু নয়, ব্যোমকেশকে তিনি দিয়েছিলেন মানবিকতার জাদুস্পর্শ। তাই ‘রক্তের দাগ’ গল্পে আইন নয় মানবিকতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল ব্যোমকেশ। শরদিন্দু নিজে আইন পড়েছিলেন বলেই বোধহয় বিচার ব্যবস্থার প্রহসন তিনি বুঝতে পারতেন। আর এইসব অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই ব্যোমকেশ আজও এক এবং অদ্বিতীয়। হাতে বন্দুক নেওয়া গোয়েন্দা নয়, সত্যান্বেষী বাঙালির ঘরের ছেলে হয়েই চিরনবীন।
POPxo এখন ৬টা ভাষায়! ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি আর বাংলাতেও!
Picture Courtsey: Subhadip Mukherjee, Gautam Moitra, Facebook and Instagram